Tuesday, September 18, 2018


রেশমগুটি
~কল্যাণী রমা
********




'Hold with both hands...each precious, glittering moment of your life.'
~ অনন্য-কে



অনন্য,
প্রতিদিন এই যে লেখাগুলো লিখছি, সব তোমার জন্য আমি কি ভাবি, কিভাবে কাটে আমার দিন সব তোমাকে জানাতে চাই আঠারো বছর হতে যাচ্ছে তোমার এদেশের মাপকাঠিতে প্রাপ্তবয়স্ক তুমি তোমার পৃথিবীতে এরপর মাথা উঁচু ক'রে ঘুরে বেড়াবে আমি পিছুটান হব না শুধু আমার মূল্যবোধটুকু , আমার ভাবনাগুলো, আমার মন খারাপ আর আমার আনন্দ তোমার জন্য রেখে যাচ্ছি আমি জানি বাংলা জান না বলে তোমার সংকোচ আছে তুমি হয়ত সত্যিই আমার এ লেখা পড়তে পারবে না কিন্তু মানুষ পারে না এমন কি কাজ আছে পৃথিবীতে ?
আমি খুব বেশি জিনিসকে ভয় পাই না কিন্তু বড় বেশি ভয় পাই সন্তানের সাথে দূরত্বকে আমি চাই তোমাকে চিনতে তোমার কি ভালো লাগে, তোমার কিসে রাগ হয় , জানি কি আমি? তুমি কোন কথাগুলো বলতে পার, কোনগুলো পার না , বুঝি কি আমি?
ছেলেবেলার তোমাকে আমি জানি প্লে ডো দিয়ে একসাথে নানা কিছু গড়তাম আমরা, পাইরেট, তলোয়ার, মাথার মুকুট কাগজের নৌকা বানাতাম উইস্কনসিনের বসন্তকালে বরফ গলা জলে তারপর সেই নৌকা ভাসিয়ে দিতামআমরা একসাথে মোমবাতি গড়তাম তোমরা আমাদের কুকুর টংসা, সিম্বার পিঠে চেপে রাজপরিবারের সদস্য হতে ওরা ঘোড়া হাঁটতে হাঁটতে নদীর পাড়ে গিয়ে আমরা সবাই মিলে হিকরি গাছের পাতার শব্দ শুনতাম আমার যা ভালো লাগত, তোমাকে আর লাবণ্য-কে শেখাতাম, তোমরাও তা ভালোবাসতে কেননা অন্য কোন পৃথিবী তোমাদের চেনা ছিল না তোমার সাথে আমার খেলবার জন্য থাকত কাঠি, পাথর , ফুল আমি ভাবতাম ব্যাটারি অপারেটেড খেলনা দিলে বাচ্চাদের মাথা নষ্ট হয়ে যায় কোনদিন একটাও ব্যাটারি অপারেটেড খেলনা কিনে দেই নি আমি তোমাকে
আজকাল তুমি পাতা দিয়ে, ফুল দিয়ে আর খেল না তুমি বড় হয়ে গেছ 
দেশ হলে আঠারো বছর তো কি হয়েছে বাবা, মা জোর জবরদস্তি করে নিজেদের মতামত বাচ্চাদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে এদেশে তেমন করা যায় না এটা ভালো কি মন্দ আমি জানি না শুধু জানি আমি তোমার ভালো চাই কিন্তু ভালো চাইতে গিয়ে শেষে খারাপ না করে ফেলি
খুব মনোযোগ দিয়ে আমি তোমাকে বোঝবার চেষ্টা করি তুমি কি চাও, কি তোমার ভালো লাগে কোন কথা বলবার আগে তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি এখন এই কথাটা বলা ঠিক হবে কিনা
যে কোন সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে রেসপেক্ট শ্রদ্ধাবোধ না থাকলে সে সম্পর্ক টেকে না দেখেছি আমাদের দেশে শ্রদ্ধা হচ্ছে উর্দ্ধগামী স্নেহ নিম্নগামী কিন্তু এদেশে দেখি শ্রদ্ধাও নিম্নগামী  পাঁচ বছরের বাচ্চার মতামতকেও রেসপেক্ট করে বাবা মা  বড় ভালো লাগে আমার  
আমি তোমার মা বলেই যে তুমি আমার অধিকারে, তা আমি বিশ্বাস করি না তুমি মুক্ত তুমি তোমার মত মানুষ, আমার মত নও, অন্য কারোর মতও নও
তুমি আমার এই রেশমগুটির ঘর কেটে ঝলমলে প্রজাপতির মত পৃথিবীতে উড়ে বেড়াবে সেই আমি চাই সেই আমার স্বপ্ন আমি আমার রেশমগুটির রেশম সুতার দড়াদড়ি নিয়ে শুধু যেন তাকিয়ে তা একটু দেখতে পাই
~ মাম






ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
১লা জানুয়ারি, ২০১৮
বাইরে যতদূর চোখ যায়, বরফ রোদ উঠেছে যদিও ঝকঝকে একটা কালো রঙের ছোট জাঙ্কো পাখি এসে আমার জানালার কার্নিশে বসেছে এইমাত্র পোলাও, মাংস আর মাছের চপ রান্না করে উঠলাম জাঙ্কো পাখিটাকেও খাবার দিতে যাব বহুদিন পাখিদের খাবার দেই নি আমি ২০১৭ ভালো যায় নি আমার
সকাল থেকে কানে হেডফোন দিয়ে গান শুনছি ,
সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা
কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।
যা-কিছু পায় হারায়ে যায়, না মানে সান্ত্বনা।।
সুখ-আশে দিশে দিশে বেড়ায় কাতরে
মরীচিকা ধরিতে চায় এ মরুপ্রান্তরে।।
মরীচিকা ধরিতে চায় এ মরুপ্রান্তরে।।
মনটাকে শক্ত করে বাঁধছি ঈগল বৃষ্টির মেঘের উপর দিয়ে উড়তে পারে বৃষ্টির ছাঁট লাগে না ওর গায়ে প্রশান্তিতে ভরে উঠুক আমার চঞ্চল মন
২০১৮ শুভ হোক তোমার, তোমাদের, আমার





ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
২রা জানুয়ারি, ২০১৮
নতুন বছর এসে গেলেও এখনো কেউ খ্রিস্টমাসের আলো নামিয়ে ফেলে নি। পাশের ডাক্তারদের বাসায় গম্বুজের চূড়ার মত বাড়ির ছাদ পর্যন্ত সাদা আলো দিয়ে সাজিয়েছে। ঝোপের উপর দিয়েছে লাল, নীল রঙ । যেন ফুল ফুটে আছে। অন্য পাশের নেইবার প্যাট আইসিকল আলো দিয়েছে। একদম সামনের বাসায় থাকে এক ইহুদী পরিবার। ওদের আলোর উতসব হানুকা এই হ’ল কিছুদিন আগে। বাড়ির সামনের জানালায় মেনোরাহতে করে মোমবাতির আলো জ্বেলেছিল ওরা। ভেবেছিলাম এ বছর দিপাবলীর সময় বাড়ির সামনেটা প্রদীপ দিয়ে সাজাব। ঈশ্বর বিশ্বাস করি না বলে ধর্মের সাথে যুক্ত কোন কাজ করতে গেলেই আমার বড় বাঁধ বাঁধ ঠেকে। বিশেষতঃ হিন্দু ধর্মের। ধর্ম বাদ দিয়েও শুধু আলোকে বুকে টেনে নেওয়ার জন্যও শেষ পর্যন্ত প্রদীপ আর জ্বালানো হয় নি আমার।
খ্রিস্টমাসের আলো যদিও আমি অনায়াসেই জ্বালাই। এ বছর অনেক আলো দিয়ে সাজিয়েছি ইয়ার্ড। আইসিকল আলো দিয়েছি। যেন বরফ আলো হ’য়ে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। আলোর গাছ করেছি একটা। ডাল, পালা সব ভেসে যাচ্ছে সাদা রঙে। আমার দরজায় ঝুলছে রীদ। সবুজ ঝাউপাতার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে লাল রঙের ছোট ছোট বেরী। ইয়ার্ডের মাঝখানে তিনটা আলোর রেইন ডীয়ার। মা, বাবা আর বাচ্চা একটা।
আজকাল বিকাল পাঁচটার দিকেই মাঝরাতের মত অন্ধকার হয়ে যায়। ঠান্ডাটা মনে হয় আরো বেড়েছে। বাতাসের জোরও খুব বেশি। শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে। আমি আমার ইয়ার্ডের খ্রীস্টমাসের আলো জ্বালিয়ে দিয়ে ঘরে এসে রকিং চেয়ারে বসি। চেয়ারের পাশেই ফায়ারপ্লেস টা। কাঠ দিলেই গরম ওম আমাকে ঘিরে ফেলবে। কাঠ দেওয়া হয় না।
ঈশ্বর নেই বলেই যে আমার চাওয়া কিছু কম আছে, এমন নয়। নিভে থাকা ফায়ারপ্লেসটার পাশে বসে আমিও ফিস্‌ফিস্‌ ক’রে বলে উঠি, ‘আলো দাও, উষ্ণতা দাও।’





ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
৩রা জানুয়ারি, ২০১৮
এক কাপ চা নিয়ে বসেছি। শীতের সকাল। চা-র কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে। যদি ছবি আঁকতে পারতাম ওই ধোঁয়া দিয়ে বাতাসের বুকে ছবি আঁকতাম। সে ছবি বাতাসে কিছুক্ষণ ভেসে থেকে আবার মিলিয়ে যেত। একবার একটা বুদ্ধা বোর্ড কিনেছিলাম। বাঁশের তুলি জলে ভিজিয়ে বোর্ডে আঁকতে হ্য়। জল শুকিয়ে গেলে ছবিও বাতাসে মিলিয়ে যায় । ছবি মিলিয়ে গেলে ছবির পিছনের যন্ত্রণা, কষ্ট, ভালোবাসা, প্রেম সবই কি শেষ হয়ে যায় ? অপমান, হিংসা কতদিন বেঁচে থাকে? কিভাবে সব কালোর উপরে উঠতে পারে মানুষ? ধ্যান আমি করি না। শুধু একা একা কিছুতেই কি সম্ভব আলোয় ভেসে যাচ্ছে এমন কোথাও পৌঁছে যাওয়া? হৃতপিন্ডের যে রক্ত চোখে দেখা যায় না, তার রঙও লাল। 

ভেবেছি এ বছর প্রতিদিন এক প্যারা করে হলেও লিখব। লিখব বরফে ঢেকে যাওয়া পৃথিবীর বুকে খাবার খুঁজতে আসা কাঠবিড়ালীর গল্প, চিকাডির নরম তুলতুলে বুক আর পাইন বনের কথা লিখব বেদনার গল্প, প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে গিয়ে সে বেদনাকে অতিক্রম করবার কথা, আমার মুক্তি আমার গাছেদের গল্প আর ব্যক্তি জীবনের যুদ্ধকে ভুলে গিয়ে মানুষের যুদ্ধের কথা ‘কান্নাহাসির–দোল-দোলানো’ এই জীবন আমাদের।   









ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
৪ঠা জানুয়ারি, ২০১৮
দিদা চলে গেছে।  আজ  ৪ ঠা জানুয়ারি।  দিদার বাসরিক শ্রাদ্ধ।  প্রায় এক মানুষ সমান উঁচু  দিদার  ছবিতে সাদা ফুলের মালা।  প্রিয় মানুষেরা চারপাশ ঘিরে।  আমার প্রিয় মানুষদের আমি দিদার গল্প বলি। অপ্রিয় মানুষদের সামনে  দিদার নাম ও করিনা। ঝিনুকের ভিতরে মুক্তার মত লুকিয়ে রাখি
মৃত্যু কি? জীবনের পরে, মানুষের শেষ অচেনা?  মানুষের শেষ ভয়? 
পনেরো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায় দিদার। গল্প শুনেছি যখন মেয়ে দেখতে এসেছিল বরপক্ষ, দিদাকে প্রথামত বলেছিল চুল দেখাতে দিদাও ঘাড় কাত ক্রে দাঁড়িয়ে খোপার রুপার কাঁটা খুলে ঝপাত্রে চুল খুলে দিয়েছিল হাঁটু ছাড়িয়ে লম্বা কালো চুল বরপক্ষদের উচিত উত্তর হয়েছিল ‘বাবা, মেজাজ আছে মেয়ের!
দিদার মত ছেলেমানুষের মত বড়মানুষ আমি আর কোথাও দেখি নি আমাদের সাথে লুডু খেলা, দাবা খেলা, স্ক্র্যাবল খেলাদিদার জুটি মেলা ভার দুপুরবেলা বাসায় ক্যাম্পাসের মাসি-রা উপস্থিতমাসিমা, উলের এই প্যাটার্নটা একটু দেখিয়ে দেবেন?’ দিদা বেশীদূর স্কুলে পড়াশোনা করবার সুযোগ পায় নি। কিন্তু এত অসম্ভব মেধাবী যে আমি ভাবি যে কোন প্যাটার্ন ম্যাচিং এলগরাদিমও বুঝি দিদা অনায়াসে লিখে ফেলবে। নেশাগ্রস্তের মত বই পড়ত দিদা । সবুজসাথী থেকে মা’র পি এইচ ডি থিসিস। যে মানুষ চলে যায়, তাকে প্রতিদিন কিভাবে মনে ক’রা যায়? আমি দিদার করা রান্নাগুলো করি। ফুলকপির ডালনা, পিঠালি দিয়ে মুচমুচে বেগুন ভাজা, সরষে ইলিশ, জিরা দিয়ে পাবদা মাছের ঝোল। ঠিকমত হয় না শিকাগোর ফ্রোজেন ইলিশ আর পাবদা মাছে! আমার ফুলকপিও বুঝি ফসলের জমি থেকে দোকানের শেল্‌ফের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল আজ থেকে এক মাস আগে! তবু...
আজ ভাবছি দিদার মত করে পুঁইশাক দিয়ে চিংড়িমাছ রাঁধব। গত পঁচিশ বছরে এক বারও রাঁধি নি আমি পুঁই চিংড়ি। অমলের চিংড়িমাছে এলার্জি। খুব বেশি চিংড়িমাছ আসে না আমাদের বাসায়। সবাই না খেলে কিভাবে কিছু বেশি বেশি খাওয়া যায়? অথচ আমার খুবই প্রিয় চিংড়িমাছ । যতবার ভেজিটেরিয়ান হয়েছি চিংড়িমাছের শোকে আকুল হয়েছি । তাই চিংড়িমাছ এলে তা দিয়ে সবচেয়ে উপাদেয় পদটি রেঁধে ফেলি। নারকেলের দুধ দিয়ে দিদার মত ক’রে চিংড়িমাছের মালাইকারি।
আজ আমি মালাইকারির বড় বড় চিংড়ি কেটে কুটে তা দিয়েই পুঁইশাক-এর সাথে বসিয়ে দিলাম। অনন্য, লাবণ্য-কে ‘উ’-র রেসিপি বলতেই, ‘sure, we will try it.’ আমার দিদাকে ওরা ‘উ’ বলে ডাকে।
শেষের দিকে দিদা খুব কষ্ট পাচ্ছিল । ঢাকা থেকে খবর আসে। দিদা বহুদিন আগের নিজের ছেলেবেলার কথা বলছে, কিন্তু দুপুরে ভাত খেয়েছে কিনা বলতে পারছে না।  দিদার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। দিদা লোক চিনতে পারছে না। আমি সব শুনি। আমার কান্না পায় না। এক বছর পর দিদার অস্থি নিয়ে আমার বড়মামা কোলকাতা গিয়ে গঙ্গায় অস্থি বিসর্জন দেয়। আমি বুক বেঁধে থাকি। দিদার কোলে চেপে আমার সাতমাস বয়সের ছবিগুলো দেখি। দিদার পরনের জামদানী শাড়িটার দিকেই চোখ চলে যায়।
দিদার চলে যাওয়ার এক বছর হ’ল। দিদার মত করে পুঁই চিংড়ি রাঁধব আজ। এতদিন একবারও কাঁদি নি। অথচ তুচ্ছ পুঁই চিংড়ি রাঁধতে গিয়ে আজ আমি আর চোখের জল ধরে রাখতে পারলাম না।



ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
৫ই জানুয়ারি, ২০১৮

আজ থেকে বছর কুড়ি আগে যখন ম্যাডিসন আসি, এখানে তখন তেমন পটল পাওয়া যেত না যখন পাওয়া যেত, দাম নিত আট ডলার পাউন্ড দেশে থাকতে পটল আমার কোনদিনই প্রিয় ছিল না কিন্তু এদেশে এসে দেশের জন্য মন কেমন করলেই আমার পটল খেতে ইচ্ছে করত ঠিক বুনো না হলেও কেমন একটা জলজ মত গন্ধ পটলের দেশে দিদা পিঠালি দিয়ে পটল ভাজত, ঘি দিয়ে খেতাম পিঠালি ছাড়া পটল ভাজত, মুশুরির বা মুগের ডাল দিয়ে খেতাম পটলের দোলমা করত, করত দোপেঁয়াজা, সর্ষে পটল, পটলের ডালনা, নারকেলের পুর ভরে পটল সবচেয়ে প্রিয় ছিল যদিও পটলের খোসার ভর্তা খোসাগুলো আর রসুন অল্প তেলে ভেজে নিত দিদা  আর কালোজিরা শুকনা তাওয়ায়  টেলে নিয়ে সব একসাথে শিল  পাটায় বাটত খুব  মিহি করে তারপর সরষের তেল দিয়ে মেখে ভর্তা  কী ভালো যে হত খেতে সবটুকু ভাত খেয়ে ওঠা যায় ওই ভর্তা দিয়ে এ রান্না দিদার মা'র রেসিপি , মানে আমার বড়মা' আমি জীবনে কোনদিন শিল পাটা ছুঁয়ে দেখি নি  এ রান্নাও হারিয়ে গেছে আমাদের বাড়ি থেকে  কেউ আর করে না
মুসলিম বন্ধুদের কাছে শুনেছি মাংসের পুর ভরে পটলও খুব ভালো হয় হিন্দু বাড়ি আমাদের মাংসের ঝোল ছাড়া মাংসের আর নানা রকম রান্না কেউ জানে না ফলে পটল ভাজি খেয়েই ছেলেবেলার বেশিরভাগটা কেটেছে অবশ্য এই সব ভাজা নিয়েও গল্প আছে আমার দাদুভাই সব সময় কি রান্না হবে তা দিদাকে সকালবেলা উঠে বলে দিত দাদুভাই না বললে দিদা রাঁধতে পারত না একদিন দেখি দিদা বেগুন নিয়ে বসেছে ডালের সাথে বেগুন ভাজা হবে দাদুভাই হাঁইমাই ছুটে এল না, না আজ পটল ভাজা হবে দিদাও নির্বিকার পটল ভাজতে শুরু করল মোটেও পতিদেবতা controlling, demanding এসব ভাবল না আমি হলে নিশ্চয়ই বলতাম, "যা রেঁধেছি তা চাঁদমুখ করে খেয়ে নাও"

বহুদিন পর পটল কিনেছি আজ পটল ভাজি আর পটলের ডালনা করব একটু বেশি তেল লাগে ডালনায় তেলে তেজপাতা, পাঁচ ফোড়ন দেব আলু, পটল ডুমো ডুমো করে কেটে লাল লাল করে ভাজব তার পর আবার তাদের এক সাথে ভেজে, হলুদ, জিরে, লবণ দিয়ে কষাব জল দিয়ে ফুটলে নামানোর আগে ঘি, গরম মশলা দেব আমি পটলের আর কিছু রাঁধতে পারিনা দিদার পটলের নানা রকম রান্নাগুলো শুধু আমার জিভে লেগে আছে বাকিসব হারিয়ে গেছে আমার ছেলেমেয়েরা পটল ভাজি খায় ডালনা খায় না আমাদের জেনারেশনের সাথে সাথে এমনি করেই আরো কত কিছু হারিয়ে যাবে তেলের উপর পাঁচ ফোড়ন ছিটকে পড়ে ছেলেবেলার এক অদ্ভুত গন্ধ শুধু মাঝে মাঝে ভেসে আসবে ভেসে আসবে ঘি, দারচিনি, এলাচ আর সুন্দরী তেজপাতার গন্ধ আর আমি বর্তমানে ফিরে এসে খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যায় এমন অর্ধেক সিদ্ধ কিছু ডিপ ফ্রিজ থেকে বের করে খুব দ্রুত তা রান্না করে ফেলব



ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
৬ই জানুয়ারি, ২০১৮
সকালে ঘুম ভেঙ্গে বালিশে মাথাটা কাত করে আরো কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলাম মাথার ভিতর হুঁড়মুড় করে কথা ভেসে এল যারা আমাকে ভালোবাসে নি সেইসব মানুষদের কথা  নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে আমি নরম সাদা তুলতুলে ডাউন কমফরটারের নীচে ডুবে যেতে থাকলাম হাঁসের পালকের উত্তাপ আমার শরীরে
এইসব মানুষ আমাকে কষ্ট দিয়েছে আমি তাদের ভুলে যেতে পারি নি ক্ষমা করতে পারি নি তাদের কথার উত্তরে উত্তরও দিতে পারি নি
আমার অস্থির মন আরো অস্থির হয়ে ওঠে আঙ্গুলগুলো কাঁপতে থাকে জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়তে থাকে মনে হয় আমার অভিশাপ ওদের জীবন ধ্বংস করে দিক
আমি এক হাতের ভিতর আরেক হাতের আঙুলগুলো ঢুকিয়ে চোখ বন্ধ করে উঠে বসি নিঃশ্বাস ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে আমি নিজেকে অতিক্রম করে যাওয়ার চেষ্টা করছি
বাইরে বরফ ক্র্যাব আপেলের গাছটা দাঁড়িয়ে আছে গাছে কোন পাতা নেই শুধু কিছু লাল রঙের শুকিয়ে যাওয়া ছোট ছোট ক্র্যাব আপেল গাছে ঝুলে আছে হঠাত্কোথা থেকে যেন একটা ব্লু জে পাখি এসে একটা ছোট ক্র্যাব আপেল ঠোঁটে করে নিয়ে দূরে উড়ে চলে গেল পাখিটার গা চোখ ধাঁধানো নীল



ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
৭ই জানুয়ারি, ২০১৮


দুঃস্বপ্ন দেখে ধড়ফড় করে বিছানার উপর উঠে বসেছি সমুদ্রের বড় বড় ঢেউ এসে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছে আমি ওলটপালট খেয়ে বালিতে পড়ে যাচ্ছি কূলেই আছি তবু পা পিছলে যাচ্ছে হাতের নীচ থেকে সরসর করে বালি সরে যাচ্ছে নোনা জল আমার চোখে মুখে আমি চেষ্টা করেও কিছু আগলে রাখতে পারছি না জীবন সরে যাচ্ছে
অথচ একটু দূরেই একটা সাদা সীগাল ঢেউ-এর উপর দুলে দুলে চলেছে ও ডুবে যাচ্ছে না জলে ভেসেও যাচ্ছে না
মানুষই শুধু মৃত সম্পর্কের লাশ বয়ে নিয়ে বেড়ায় নকশাকাটা রূপার কৌটায় বেদনার পান্ডুলিপি রেখে দেয়




ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
৮ই জানুয়ারি, ২০১৮

পানাপুকুরের পাঁকে পা আমার গেঁথে গেছে জীবনের সুর আমার কানে আর ভাসছে না এমনটি যে হ'তে পারে তা আমি কোনদিন ভাবিনি তবু হাঁচড়ে পাঁচড়ে আমি এক পা এক পা ক'রে ঠিক তীরে এসে পৌঁছেছি আমি বাঁচবই
মানুষের জীবন একটাই আমার ঈশ্বর বিশ্বাস নেই বলে স্বর্গ , নরকও নেই ফলে এই বেলা যে ফুল আমি ফোটাতে পারলাম সেই আমার গলার মালা হৃতপিন্ড ফেটে গেলেও সে ফুল আমি ফোটাব
গান আমি গাইতে পারি না আকাশ ভরে দিয়ে চোখের জলকে মুক্তা দানায় ভরে দেওয়ার অমৃত শক্তি আমার নেই আমার শুধু বুকের কাছটায় যখন দমটা বন্ধ হয়ে আসে, আমি লিখতে শুরু করি সে লেখা আমায় বাঁচিয়ে রাখে রাত যত গভীরই হোক, ভোর হলে আকাশ ভরে দিয়ে পাখিরাই গান গায়



ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
৯ ই জানুয়ারি, ২০১৮

বাংলা ভাষায় ভারহীন শব্দটার যে কি মানে, তা আজ বুঝতে পারলাম। এতদিন শব্দটা শুনতাম, কিন্তু নিজের শরীরের চামড়া দিয়ে বুঝতে পারতাম না। আজ শরীর থেকে ভার নেমে গেছে। গাছের পুরানো বাকলের মত তা মাটিতে পড়ে আছে। ঝকঝকে রোদ বাইরে। বিশ্বাস হচ্ছে রাত শেষ হলে ভোর হয়। যদিও রাতের অন্ধকারের ভিতর বসে চোখের জল ফেলতে ফেলতে মনে হয় এ রাত বুঝি আর কোনদিন শেষ হবে না। যে সুর গোপন গুহা হতে ছুটে আসে আকুল স্রোতে, কান্নাসাগর-পানে যে যায় বুকের পাথর ঠেলে।।তারপর ব্যথায় বুকের ভিতরের সব কথাগুলো যখন শেষ হয়ে যায়, হাতের কাছে পড়ে থাকে রবীন্দ্রনাথ 
‘আমি মারের সাগর পাড়ি দেব বিষম ঝড়ের বায়ে
আমার ভয়ভাঙা এই নায়ে।।
......
আমি অভয় মনে ছাড়ব তরী, এই শুধু মোর দায়।।
দিন ফুরালে, জানি জানি, পৌঁছে ঘাটে দেব আনি
আমার দুঃখদিনের রক্তকমল তোমার করুণ পায়ে।।’
মানুষ আমাকে রক্তাক্ত করেছে। যীশু খ্রীষ্ট মাথায় কাঁটার মুকুট পড়ে হাতে, পায়ে পেরেক গেঁথে পৃথিবীর সব মানুষকে পাপমুক্ত করে গেছেন। আমি তার মত ঈশ্বরের পুত্র নই। আমার রক্তপাত শুধু আমার হৃতপিন্ডের। আমার রক্তপাত শুধু আমার চোখের জলে

কিন্তু আজ সূর্যের আলোর দিকে তাকিয়ে মনে হল রাত শেষ করে চারদিক ঝলমল করে জেগে উঠতে সূর্য তো ভয় পায় নি। সে নির্মল। তার কুন্ঠার কি আছে?
আমি আমার দুঃখদিনের রক্তকমল জীবনের পায়ে একটু ছোঁয়াবার জন্য আজ পথে নামলাম। আমার যা হবার তা হোক।
ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
১০ই জানুয়ারি, ২০১৮

কাল ভেবেছিলাম ভারমুক্ত হয়েছি আজ দেখি জীবনের নৌকা বালুচরে আটকে গেছে আমি সামনে যেতে পারছি না, পিছনেও না। ঝরঝর করে দু’চোখ থেকে জল ঝরছে। হলুদ রঙের নরম পাখির বুক খুঁজছি । ভাবছি হাতের মুঠোয় সে পাখি নিতে পারলে তুলতুলে জীবনের ভালোবাসা আমায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবেআমার সামনে পথ নেই। ভুল করে যাকে পথ বলে ভাবছি, তা আসলে কিছুদূর গিয়ে গভীর ঘন জঙ্গলের মাঝে হারিয়ে গেছে
ভাবছি বালুচরে আটকে যাওয়া নৌকাকে ধরে জোরে ঠেললেই তা কি আবার স্রোতে ভাসবে না? সব সময় নৌকা আবার স্রোতে ভাসে না। তার গায়ে ছেঁড়া, পড়ে থাকা দড়িদড়া জমা হয় । তার গায়ে বহুদিন আগে ফেলে আসা কোন স্বপ্নের ধ্বংসাবশেষ জমা হয় ।
এ নৌকার উপরে একদিন খুব বড় একটা চাঁদ উঠেছিল। ভালোবাসায় চারদিক ভেসে গিয়েছিল। মানুষ বদলে যায় । তার হাতের মুঠো থেকে একটা সোনার মোহর অনেক গভীর জলের ভিতর হারিয়ে যায়। চোখ ফিরিয়ে দেখবার মত সময় কিছুতেই হয় না।



ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
১১ই জানুয়ারি, ২০১৮

প্রায় বছর চার আগে আমরা শহরের ভিতর এই বাড়িটায় এসেছিলাম। শহরের বাড়িতে সবকিছু কাছাকাছি। আমাদের সেই গ্রামের বাড়ির মত নয়। গ্রামের বাড়ির নদী, তারা, ঘুঘু পাখি, ব্লু জে সব ছেড়ে যখন আসলাম, আমার মনে হয়েছিল বোধ হয় আর বাঁচব না। কিন্তু মানুষ খুব সহজেই স্মৃতিকে জলের মত পান ক’রে বেঁচে থাকতে পারে।
শহরে এসে যখন পাখিদের খাবার দিতে শুরু করলাম, দেখি প্রতিদিন আসে এক কার্ডিনাল দম্পতি। লাল টুকটুকে কার্ডিনালদের বরফের উপর বসে থাকতে দেখে এত অদ্ভুত সুন্দর লাগে। সাদার উপর লাল রক্তের দাগ। কার্ডিনাল অনেকটা আমাদের দেশের বুলবুলির মত দেখতেমাথায় একই রকম ঝুঁটি বাঁধা। শুধু রংটা আলাদা। দেখতাম মেয়ে কার্ডিনাল পাখিটা চুপ ক’রে বসে থাকে। আর ছেলে পাখিটা আমার বার্ড ফীডার থেকে এক একটা সূর্যমুখী ফুলের বিচি নিয়ে মেয়ে পাখিটার মুখে গুঁজে দেয়কার্ডিনাল দম্পতিকে দেখে আমি মুচকি হেসে মনে মনে বলতাম, ‘এ প্রেম অমর হোক। কারো নজর না লাগে।’
আজ এক অদ্ভুত কান্ড। দেখি বেলা একটার সময় একটা ছোট, বাচ্চা কার্ডিনাল পাখি আমার ফীডারে। ওই দম্পতির বাচ্চা বুঝি? পাখিটার গালগুলো বেশ ফোলা ফোলা। মানুষ বাচ্চাদের মতই। ঝুঁটিটা চনমনে নতুন। গায়ে যেন নতুন পালক। বুক ফুলিয়ে খুব সাহসী বীরের মত বাচ্চা কার্ডিনাল সূর্যমুখী ফুলের বিচি খেতে থাকল। আমি শুধু বললাম, ‘কি রে তোর বাবা, মা আজ আসবে না?’ জানি না কেন আমার ফীডারে পাখিগুলো সব সময় দুপুর একটার দিকে খেতে আসে।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। বাইরে মাইনাস চৌদ্দ ডিগ্রী ফারেনহাইট মানে মাইনাস সাড়ে পঁচিশ ডিগ্রী সেলসিয়াস। কার্ডিনাল ওর দিনের শেষ খাবারটুকু মুখে নিয়ে চলে গেলআমি চারদিকের বরফ ছাওয়া পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে সূর্যমুখী ফুলের রোদ ঠিকরে পড়া ঝলমলে রঙের কথা ভাবতে থাকলাম




ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
১২ই জানুয়ারি, ২০১৮

পাখির হলুদ, নীল পালক নিয়ে গল্প করব, এমন লোক বেশি খুঁজে পাই না মটরশুঁটির বীজপত্র ফুঁড়ে যখন কোমল চারা মাটি ঠেলে বের হয়, সেই অসীম আনন্দ ভাগাভাগি করে নেব এমন কেউও হাতের কাছে নেই একটা বাদামি মত কাগজে টালি দাগ দিয়ে তাই নিজেই হিসাব রাখি, আজ একটা চারা, কাল দুই আজ একটা রবিন পাখির নীল ডিম, তিন দিন পর চার চারটা বুকের ভিতরটা ভালোবাসায় ভরে ওঠে
ভালোবাসা ছোঁয়াচে রোগ আমার পাখির ডিম আর পালকের ভালোবাসা মহামারী আকার নিয়ে নিজের ছানাপোনাদের উপর বর্তায় মাটির নীচে গর্ত করে চারার শিকড় কতদূর গেল তা আমি দেখতে যাই না বটে, কিন্তু নিজের ছানা পোনাদের সবকিছুতে সর্দারি করবার লোভ আমি কিছুতেই ছেড়ে দিতে পারি না শুধু ভয় এই বুঝি কোন ক্ষতি হয়ে গেল এই বুঝি ওদের আমাকে চাই মা পাখি আমার থেকে বেশি বুদ্ধি রাখে সময় হয়ে গেলে ঠেলে ফেলে দেয় বাসা থেকে। বাচ্চা পাখি উড়তে শেখে।
আমি বাদামি কাগজের টালি মার্ক দেখি। নীল ডিম...হলুদ পালক...আজ একটা অপরাজিতার চারা। কাগজ থেকে চোখ তুলতেই চোখে পড়ে কাঠের দরজার গায়েও দাগ কাটা। মোমের রঙ দিয়ে। আমার অনন্য, লাবণ্য দুই ফুট ছিল।





ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৮

মায়ের নাড়ি ছেঁড়া ধন তার সন্তান। নিজের হৃপিন্ডের টুকরো থেকেই যেন ওদের হৃপিন্ড গড়ে উঠেছে। কিন্তু সত্যি সত্যি তো আর আসলে তা নয়। ওরা সম্পূর্ণ মানুষ, মুক্ত মানুষ, স্বাবলম্বী মানুষ। ওরা কারো অধিকারে নয়। 
ছেলেমেয়েদের বয়স হয়ত আঠারো, ঊনিশ হয়ে গেছে, তবু ওরা কি পেট ভরে খেল? রাতে ঘুমাল কি পর্যাপ্ত? ছেলে মেয়ে হয়ত একটু মাটিতে পড়ে ব্যথা পেয়েছে। সাথে সাথে মনে হয় কেউ বুঝি মা-র পেটে লাথি মারল। তীক্ষ্ণ ব্যথা। কিভাবে এমন সম্ভব? হাঁসের ছানারা মা হাঁসের পিছু পিছু হেলেদুলে চলে, কিন্তু একটা বয়সের পর মা ছেড়ে দিতে শেখে। মানুষ মা’ই শুধু তা শিখে উঠতে পারে না? যতক্ষণ ওরা না ঘুমাবে, জেগে বসে থাকবে। যতক্ষণ ওরা না খাবে, না খেয়ে থাকবে। ছেলে মেয়েরা কিন্তু নিজেদের জগতে বিভোর হয়ে থাকে। সেখানে ওদের বন্ধু আছে, সেখানে ওদের ব্যস্ততা আছে, ওদের একটা আলাদা জগত আছেমা-কে কেমন আছ বলবার পর আর কোন কথা ওরা খুঁজে পায় না। অনেক আশা নিয়ে মা বসে থাকে। ওদের সাথে গল্প করবে। ওদের ছেলেবেলার গল্প। ওরা কি করত। কিভাবে হেসে গড়িয়ে পড়ত। কিভাবে ললিপপ নিয়ে মারামারি করে পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসত। মা কিভাবে ওদের নানা খেলনা বানিয়ে দিত। একবার জন্মদিনে পাঁচ ঘন্টা ধরে আইসক্রীম কেক বানিয়েছিল। আর একবার সেই যে সেই বিখ্যাত বব দ্যা বিল্ডার কেক। ববের মত চেহারা কেকের। সাথে আবার হাতুড়ি আছে। জন্মদিনে মা সবসময় জামা বানিয়ে দিত মেয়ের।  লাল শাদা পোলকা ডট। একটা পুতুলও বানাত। তার পরনেও একই রকম ম্যাচিং জামা।
দিনগুলো শেষ হয়ে গেছে। এখন পাশে পাশে ঘোরে মা। যদি ওদের কোন কাজে লাগে। কিন্তু কিছুতেই আর কোন কাজে আসে না মাওরা স্বাবলম্বী হয়ে গেছে। মা’র হাতে অফুরন্ত সময় আজকাল। মনে আছে ওদের ছেলেবেলায় ভাত খাওয়ার পর্যন্ত সময় পেত না মা। জমজ বাচ্চাদের মত বড় বেশী পিঠাপিঠি ওরা।
পৃথিবীতে বোধ হয় কারো কাছে অকেজো হয়ে যাওয়াটাই সবচেয়ে বড় অভিশাপ। বড় বেশী অসহায় লাগে বাতাসে Kahlil Gibran - এর কবিতার পাতা উল্টিয়ে যেতে থাকে।
Your children are not your children.
They are the sons and daughters of Life's longing for itself.
They come through you but not from you,
And though they are with you yet they belong not to you.

You may give them your love but not your thoughts,
For they have their own thoughts.
You may house their bodies but not their souls,
For their souls dwell in the house of tomorrow,
which you cannot visit, not even in your dreams.
You may strive to be like them,
but seek not to make them like you.
For life goes not backward nor tarries with yesterday.

You are the bows from which your children
as living arrows are sent forth.
The archer sees the mark upon the path of the infinite,
and He bends you with His might
that His arrows may go swift and far.
Let your bending in the archer's hand be for gladness;
For even as He loves the arrow that flies,
so He loves also the bow that is stable.



ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
১৪ই জানুয়ারি, ২০১৮

আজ ঠিক এক বছর হল দিদা চলে গেছে সবসময় কানে একটা সোনার দুল পরে থাকত দিদা দুলটা দেখতে একটা কলসি-কে দুভাগ করে আড়াআড়ি কাটলে যেমন হয় তার মুখটার মত চারপাশটা ঘিরে ফুল আর লতা উঁচু করে কাটা মাঝখানে একটা লাল পাথর  পাথরটা থেকে আলো ঠিকরে পড়ছে কিভাবে যে বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে সোনার আঙটা টা কানে ঢোকাত! কোনদিন অন্য কোন দুল দেখি নি দিদার কানে
সাধারণ করে শাড়ী পড়ত নাদুস নুদুস শরীর নিয়ে হেলেদুলে চলত শাদা শাড়ী, লাল পাড় আর কানে এই দুল
বড় নাতনী বলে দিদার এই সবসময় কানে পরে থাকবার দুলটা পেয়েছি আমি কোনদিন প্রাণে ধরে এই দুল আমি নিজ কানে পরতে পারব কিনা জানি না আমার দিদার কানের সোনার দুল












ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
১৫ই জানুয়ারি, ২০১৮

ঘুম থেকে উঠে জানালার পর্দাটা সরাতেই দেখি সাদা চাদরে ঢাকা পৃথিবী সারা রাত বরফ পড়েছে আমার অন কল ছিল বলে রাতে ভালো ঘুম হয় নি ভোরের দিকে চোখ লেগে গেছে আই টি লাইনে এই অন কল এক অশান্তি এমন ভাব করে সবাই যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে আরে বাপু, এত আর মানুষ নয়, ডাক্তারদের অন কল ও নয় তবু পড়িমরি অবস্থা

প্লাউ ট্রাক এসে রাস্তা কেটে দিয়ে যায় নি বাড়ি থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না অফিসে জানালাম, রাস্তা পরিষ্কার হলে অফিস যাব ততক্ষণ বাড়ি থেকে কাজ করব তবে অফিসে আজ যাবই কেননা অন কলের পেজারটা পরের জনকে দেব গত এক সপ্তাহ ধরে অনেক জ্বালিয়েছে এই পেজার মাঝ রাতে, সন্ধ্যা রাতে ডাকাডাকি

রাস্তায় বের হতে না পারলেও জানালা দিয়ে বাইরের পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে মন ভালো হয়ে গেল ধবধবে সাদা বরফের এক অদ্ভুত নিষ্পাপ সৌন্দর্য আছে কেও মাড়িয়ে যায় নি, এমন কি কাঠবিড়ালি আর পাখিও না কাঠবিড়ালিদের পায়ের ছাপ আমি চিনি পাখিদেরও গ্রামের বাড়িতে থাকতে হরিণের পায়ের ছাপ দেখতাম বরফের উপর প্রাণীদের পায়ের ছাপ দেখে দেখে প্রাণীদের চিনবার একটা চমত্কার বই আছে আমার

আজ স্কুল, কলেজ বন্ধ অনেক অফিসও মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের জন্মদিনমার্টিন লুথার কিং জুনিয়র আমেরিকার সিভিল রাইটস মুভমেন্ট-এর প্রধান পুরোধা, এক কিংবদন্তী পুরুষ কালো মানুষ আর সাদা মানুষের বৈষম্য দূর করাটাই ছিল তাঁর সংগ্রাম

ছেলেবেলায় টিভিতে 'রুটস' হত আলেক্স হ্যালি র মনে পড়ে কুন্তা কিনতে-কে হাতে শিকল দিয়ে পশুর মত বেঁধে রেখেছে পিঠে চাবুক পড়ছে কুন্তা কিনতে -র ঘামে ভেজা শরীর...

এত বছর হয়ে গেছে তবু বিভেদ ঘোচে নি আমেরিকার দক্ষিণের স্টেটগুলোর পপলার গাছ থেকে কালো মানুষের শব আজ হয়ত ঝুলে থাকে না লিঞ্চিং-এর শিকার হয়ে, তবু কোন একটা ক্রাইম হয়েছে মানেই এ কোন কালোর কাজ, এ ধরণের চিন্তা বহু মানুষের মনেই প্রথম সন্দেহ হিসাবে আজো আসে আমাদের দেশের বাদামী রঙের লোকেরাও এ বিষয়ে পিছিয়ে নেই এক পাও বাড়ি কিনবার সময় কালো পাড়ায় বাড়ি কেনে নি বলে গর্ববোধ করে তারা বলে বেড়ায় কোন কালো ছেলে মেয়ে বন্ধু নয় তাদের বাচ্চাদেরআর দেশে পত্রিকার পাতায় সেইসব 'গৌর বর্ণ পাত্রী চাই' বিজ্ঞাপনগুলো? সুন্দর কালো মেয়ে দেখলে আজো দেশে বলে 'মেয়েটা মিষ্টি দেখতে' আর ফর্সা মেয়ে দেখলে 'সুন্দরী' মা আর আমার ছোট বোন শ্যামার গায়ের রং দেশীমতে ফর্সা আর আমি তো সেই কালির দোয়াতের মত কালো আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষার সার্টিফিকেট আনতে গেছি শ্যামাকে দেখে ক্লাৰ্ক সন্তুষ্ট কিনতু আমাকে দেখে মাকে প্রশ্ন, 'আপনার মেয়ে ? নিজের মেয়ে? কালারে তো বড় ডিফারেন্স?' আমার বুদ্ধিমতী মা'র উত্তর, 'হ্যাঁ, এই মেয়ে হওয়ার সময় শুধু বেগুন পোড়া খেতাম তো, তাই ঘৃণা হয় এইসব মানুষকে দেখলে আমার বর্ণ বৈষম্য সভ্যতার অপমান!

রাস্তায় বের হওয়া যাচ্ছে আমি প্রগতিবাদী স্টেশন এন পি আর (ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও) চালিয়ে দিয়ে গাড়ি বের করি দেখি মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের সেই বিখ্যাত স্পীচটা বাজাচ্ছে আমার হাত, পা টান টান গলার কাছে শিরা ফুলে উঠছে বুকের কাছে সংকল্প বিড়বিড় করে আস্তে আস্তে গলা মিলিয়ে আমিও বলতে থাকলাম-
“I Have a Dream”
“I have a dream that one day on the red hills of Georgia, the sons of former slaves and the sons of former slave owners will be able to sit down together at the table of brotherhood.

I have a dream that one day even the state of Mississippi, a state sweltering with the heat of injustice, sweltering with the heat of oppression, will be transformed into an oasis of freedom and justice.
I have a dream that my four little children will one day live in a nation where they will not be judged by the color of their skin but by the content of their character.
I have a dream today!
I have a dream that one day, down in Alabama, with its vicious racists, with its governor having his lips dripping with the words of "interposition" and "nullification" -- one day right there in Alabama little black boys and black girls will be able to join hands with little white boys and white girls as sisters and brothers.
I have a dream today!”
আজো স্বপ্নটা সফল হয় নি



ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
১৬ ই জানুয়ারি, ২০১৮
আজ ঝলমলে রোদ ৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট মানে মাইনাস পনেরো ডিগ্রী সেলসিয়াস। উইস্কনসিনের তাপমাত্রার মাপকাঠিতে প্রায় ‘বসন্ত এসে গেছে’ বলা চলে! সূর্য উঠলেই রক্তের শিরার মধ্য দিয়ে কেমন যেন এক আনন্দ ছুটে যায়। ছেলেবেলায় পড়া তেঞ্জিং নোরকে আর এডমন্ড হিলারির এভারেস্ট বিজয়ের গল্প মনে পড়ে। তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে ওঁনারা দেখছেন আজ তাপমাত্রা কত। তুষার ঝড় হবে কিনা। মানুষের জীবনের ঝড় তুষার ঝড়ের চেয়ে কম ভয়ংকর নয়
দেশে দেখতাম মা হেমন্ত কাল এলেই সব বই খাতা, লেপ তোষক জড়ো করে লম্বা বারান্দাটায় মেলে দিত। রোদ পেয়ে সবাই আবার পরের বছর উঁইপোকা আর বই-এর সাদা পোকাদের সাথে যুদ্ধ করবার জন্য ঢাল তলোয়ার নিয়ে তৈরী হয়ে যেত। আমার উইস্কনসিনে বাইরে তো কিছু এই ঠান্ডায় রোদে দেওয়া যাবে না। ভাবলাম জানালার পাশেই পুরানো এলবামগুলো মেলে দেই। কিন্তু এলবামে রোদ খাওয়াব কি, এলবামের ছবিগুলো দেখে আমিই জীবনের রোদ পোহাতে থাকলাম।
অনন্য, লাবণ্য-র ছেলেবেলার এলবাম। একটা ছবি দেখলেই তা সিনেমার মত পরপর গল্প মনে করিয়ে দেয়। আমরা তিনজন মিলে চীজকেক বানাচ্ছি। আমার প্রাণের বন্ধু মার্গারেট-এর দেওয়া রেসিপি। গ্রাহাম ক্র্যাকারের বেসের উপর চীজ, তার উপর সাওয়ার ক্রীমের ফ্রস্টিং। তার উপরে মার্গারেট গরমকালে ভায়োলেট, প্যান্সি ফুল দিয়ে সাজায়। শীতকালে র‍্যাস্পবেরী, ব্লুবেরী, কিওয়ি, স্ট্রবেরি। ছবিতে অনন্য, লাবণ্য সাজাচ্ছে কিওয়ি  কেটে তার সবুজ দিকটা  দিয়ে। সবুজের ভিতর কালো কালো ছিট ছিট মত। তার সাথে ম্যাচ করে ব্লুবেরী দিয়ে সাদা ফ্রস্টিং ঢেকে দিচ্ছে দু’জন। মাঝে মাঝে চামচ থেকে কেকের ব্যাটার চেটে খাচ্ছে। বেক না হওয়া ব্যাটার সব সময়ই বেক হওয়া কেকের থেকে সুস্বাদু।
পরের ছবিটায় দেখি ওরা দুজন মিলে পাখিদের জন্য একটা রীদ বানাচ্ছেরীদের গায়ে পিনাট বাটার মাখিয়ে বার্ডসীড ছড়িয়ে দিয়েছে। রীদটা ঝুলিয়েছে বাড়ির সামনের সবুজ ফারগাছটায়। চারদিকে বরফ বলে খাবার নেই পাখিদের। ওরা তাই পড়িমরি অনন্য, লাবণ্য-এর বার্ডসীড ভরা রীদে।
বেলা প্রায় এগারোটা বাজে। চোখ কচলাতে কচলাতে আমার অনন্য ঘুম থেকে উঠে আমার কাছে এসে দাঁড়াল। প্রায় ছয় ফুট লম্বা। সতেরো বছর বয়স। ‘Mom, do you know what was I thinking? When I was very little…’ তারপরই অনন্য ওর আমাকে ডাকবার আহ্লাদী শব্দটা বলল ‘Momgo!’ আমি এই সুবর্ন সূযোগ ছাড়তে রাজি না জুলজুল চোখে অনন্য-কে বললাম, ‘Can I give you a hug?’
কাল আবার বার্ড ফীডার ভরে পাখিদের খাওয়ার জন্য অনেক সান-ফ্লাওয়ার সীড দিয়েছি রেড কার্ডিনাল, চিকাডি, জাঙ্কো সবাই এসেছে শীতকাল তো ওদের মরুভূমি খাবার কোথায়? কাঠবিড়ালিগুলোও পাখির খাবার চুরি করতে দুই পায়ে খাড়া আচ্ছা, ছয় মাসের লম্বা শীত-ঘুম নেই কাঠবিড়ালিদের? গুগল করতে হবে
ভাবছি আজ সরষে স্যামন রান্না করব ভাপা ইলিশের মত একবার শিকাগো থেকে ফ্রোজেন কলাপাতা জোগাড় করে তার ভিতর সরষেবাটা দিয়ে মাখিয়ে স্যামন পাতুরি করেছিলাম পরেরদিনের জন্য কিছু আর থাকে নি
লেখালিখি নিয়েও বসব একটা পত্রিকা থেকে নিভৃতচারী কবি এমিলি ডিকিনসনের দু’টো কবিতা অনুবাদ করতে দিয়েছে।
ধীরে ধীরে আমার একটা পৃথিবী হচ্ছে আর আমি ক্লিফ হ্যাঙ্গারদের মত এইসব নেশা ধরানো জীবনের রশি দুহাতে আঁকড়ে ধরে সূর্যের আলো কামড়ে ধরছি




ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
২৭শে জানুয়ারি, ২০১৮

খুব নরম তুলতুলে একটা স্পর্শে ঘুম ভেঙে গেল। এমনও হয় বুঝি? তাকিয়ে দেখি স্পর্শটা এই পৃথিবীর কারো  নয়।
স্বপ্নের ভিতর থেকে আমার কুকুর, আমার টংসা আমার কাছে এসেছে।
পায়ের কাছে সিম্বাও। স্বপ্নের ভিতর আমি সবসময় রঙ দেখি।  টংসার বাদামি গা, সিম্বার সাদা। আমার কোলের ভিতর টংসার  শরীর , বোতামের মত কালো নাক।  গোলাপি জিহবা দিয়ে আমার গাল চেটে দিল।  
জীবনভর টংসা, সিম্বাকে খোঁজা আমার আর  শেষ হবে না।
২৯ শে মার্চ, ২০০৮ সাল,  বিকাল পাঁচটায় টংসা চলে  গেছে ।  ১৫ই আগস্ট, ২০১২ সাল, রাত বারোটা পয়তাল্লিশে  চলে গেছে  সিম্বা। আচ্ছা, সব সময় মানুষ বা যে কেউ মারা গেলে  বিশেষভাবে মারা যাওয়ার  সেই সময়টা কেন বলে? বহুবার ভেবেছি।
ওরা দুজন চলে যাওয়ার পর থেকে কোনদিন স্বপ্নে দেখিনি ওদের।  এই প্রথম। ওরা বুঝি আমাকে দেখতে এসেছে?  এও কি সম্ভব?
পশুরা কোন পাপ করে না। ওরা মানুষ নয়। মৃত্যুর পর রেইনবো ব্রিজের ওপারে দৌড়াদৌড়ি করে এখন  খেলা করছে টংসা, সিম্বা । ওদের  সাথে ওখানে একদিন নিশ্চয়ই দেখা হবে  আমার ।  
“I'll Always Love You” বইটার পাতা উল্টে উল্টে দেখতে থাকলাম।



ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
২৮শে জানুয়ারি, ২০১৮

কাল খুব ঝলমলে রোদ ছিল আমি ভেবেছিলাম সূর্যমুখী ফুটেছে আমার এই বরফঢাকা ইগ্লু থেকে নাক বের করে রোদের গন্ধ শুঁকছিলাম রোদের একটা বড় সুন্দর মিষ্টি, ওম ওম গন্ধ আছে চূলা থেকে সদ্য বের হয়ে আসা মিষ্টি গন্ধ ছড়ানো নরম পাউরুটির মত বরফের দেশে রোদের গন্ধ নেশা ধরিয়ে দেয়
নেশা স্থায়ী হয় নি রাতে ঘুমিয়েছি সূর্যমুখী ফুল আর রোদের স্বপ্ন দেখতে দেখতে, ঘুম ভেঙে দেখি সাদা গোলাপের বড় বড় পাপড়ির মত বরফ পড়ছে! রাস্তা ঘাট ঢেকে গেছে বরফে দূরের চিরসবুজ পাইন গাছগুলোও বরফে ছাওয়া সূর্য নেই আমার মনের তাপমাত্রা সূর্যের আলোর সাথে ওঠানামা করে সূর্য নেই মানেই আমি অন্ধকার, শেওলা পড়া গভীর বনের ভিতর ঘুরতে শুরু করি আকাশ ছোঁয়া গাছ চারদিক ভেজা ভেজা, আমার কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করে না  নতুন ঝরে পড়া বরফের পবিত্রতাও আমাকে আনন্দ দেয় না
অন কল ছিল বলে সময়মত খ্রীস্টমাস ট্রী থেকে সব অর্নামেন্ট খুলে এক বছরের মত তা বেসমেন্টে রাখবার কাজটা করা হয়ে ওঠে নি কোথায় যেন পড়েছিলাম সবচেয়ে সুখী পাখিরা খ্রীস্টমাস ট্রী তে বাসা বাঁধে আমার আজকের সূর্যহীন দিনে তাই মনে হল খ্রীস্টমাস ট্রী-র গা ঘেঁষে থাকি একটা  একটা করে অর্নামেন্টে হাত বুলাই, খুলে রাখি
এ দেশে যখন প্রথম এসেছিলাম, আমার বন্ধু ও নেইবার ডরোথির বাড়ির খ্রীস্টমাস ট্রী দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম প্রায় ছাদ পর্যন্ত ফ্রেজার ফার পাতায় হাত দিয়ে একটু ঘঁষলে বনের গন্ধ ভেসে আসে সদ্য কাটা গাছটা জল ভরা ট্রী স্ট্যান্ডে তার পাশ ঘিরে ট্রী স্কার্ট পুরো গাছটা থেকে ঝুলছে অপূর্ব সব অর্নামেন্ট ডরোথির জন্মের সময় ওর ঠাকুমা দিয়েছিলেন একটা নীল কাচের বল ডরোথির ছেলেমেয়েদের প্রথম খ্রীস্টমাসে ডরোথির মা দিয়েছিলেন লাল উলের বোনা দুই ইঞ্চি সাইজের ছোট ছোট দুটো দস্তানা, টুপি তিন ইঞ্চি সাইজের ছোট একটা রকিং হর্স একটা লাল কার্ডিনাল পাখি সব হেয়ারলুম অর্নামেন্ট ঝুলছে গাছ থেকে ডরোথি প্রতিটা অর্নামেন্টের গল্প বলছে আমায় আমিও স্বপ্নের ভিতর ভেসে যাচ্ছি
হেয়ারলুম শব্দটা যে জীবনের সাথে জড়িয়ে নেব, আমার হাতের ছোট দুটো মুঠোয় তেমন কিছু আঁটাতে পারি নি কোলকাতা থেকে দুই সুটকেস আর দুই কুকুর নিয়ে আমেরিকায় এসেছি আমি আমার খ্রীস্টমাস ট্রী সাজানোর কোন অর্নামেন্ট তো দূরের কথা, আমার খ্রীস্টমাস ট্রী ই নেই নেই আমার জন্মের সময় কে কি দিয়েছিল তার কিছু বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য শুন্য থেকে শুরু হয়েছিল আমাদের জীবন এক কাপড়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম আমরা দেশ ছেড়ে, বেতের কাঁটা বিছানো পথ দিয়ে। এবার আবার সব ছেড়ে ছুড়ে দুই সুটকেস নিয়ে আটলান্টিক পাড়ি দিয়েছি কার্পেটের উপর চাদর বিছিয়ে শুয়ে থাকি বেতন পেলে সব আবার ধীরে ধীরে কিনতে পারব বিছানা, টেবিল, চেয়ার, সোফা ননস্টিক ফ্রাইং প্যান
আটলান্টিক পাড়ি দিতে গিয়ে দুটো মাত্র সুটকেসে সব জিনিষ ভরতে পারি নি আমি, কিন্তু মনের ভিতরের গল্পগুলো মুছে যায় নি আমার আত্মীয় স্বজন, আমার বাড়ি, আমার গাছ, আমার সূর্যভরা দিন, আমার ঝমঝম বৃষ্টি - আমার ফ্রেজার ফারের গায়ে সেই আমার হেয়ারলুম অর্নামেন্ট







ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
২৯শে জানুয়ারি, ২০১৮

বোন চায়নার গোলাপি গোলাপ ফুলের ছবি আঁকা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ডরোথির সাথে গল্প করতে করতে ওর বাড়ির এ ঘর, ও ঘর ঘুরছি। কিচেন, ডাইনিং রুম, লিভিং রুম। একটা ভারী সুন্দর কাঠের আলমারির সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমাদের দেশের মেহগনী কাঠের মত রঙ তার। কাঠে লতা, ফুল খোদাই করা। আমার চোখের মুগ্ধতা দেখে ডরোথি বলল, ‘এটা আমার ঠাকুমার ওয়েডিং ফার্নিচার ।’ ডাইনিং রুমে গেলাম। একটা কাঠের হাই চেয়ার। নীল রং করা হয়েছে ডরোথি বলল মনে হয় এই চেয়ারের বয়স প্রায় একশ বছর হবে। আমি ছেলেবেলায় এই চেয়ারে বসে খেয়েছি । তারও আগে অন্যরা আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এল । আমি স্মৃতি ছাড়া আর কিছু দেশ থেকে এদেশে নিয়ে আসতে পারি নিএকদিন আমার ঘরেও হয়ত অনেক ফার্নিচার হবে, কিন্তু সেই আসবাবপত্রে আমার পূর্ব পুরুষের স্মৃতি থাকবে না। আমার ঘরে মোচার ঘন্ট রান্না হবে, আমার ঘরে সরষে ইলিশ রান্না হবে, মাঝে মাঝে পাটিশাপ্টাও হয়ত করে ফেলব-কিন্তু কিছু দিয়েই আমি যে খালি হাতে এদেশে এসেছি তা মুছে ফেলা যাবে না আমি ফার্স্ট জেনারেশন ইমিগ্র্যান্ট।
অনন্য, লাবণ্য স্কুলে যেতে শুরু করেছে। এখানে শিক্ষকরা খুব যত্ন নিয়ে বাচ্চাদের হেরিটেজ, কালচারাল ব্যাকগ্রাউন্ড ইত্যাদি শেখায়। নিজের যা কিছু আছে তা নিয়ে যেন গর্ব করতে পারে। একদিন দেখি ওরা নিজেদের ছবি এঁকে নিয়ে এসেছেস্টিক ফিগার। কিন্তু গায়ের রং-এ বাদামি রঙের প্যাস্টেল বুলিয়েছে। মাথার চুল আর চোখের মণি কালো। আমরা তখন স্টউটনে থাকতাম । স্টউটনকে লিটল নরওয়ে বলে। নরওয়েজিয়ান ইমিগ্রান্টদের শহর এটা। হালকা সোণালি চুল আর নীল চোখ অনন্য-র বন্ধুদের। সারা স্কুলে অনন্য, লাবণ্য ছাড়া আর কোন বাদামি প্যাস্টেলে এঁকে ফেলবার মত বাচ্চা
নেই । বহু বছর পর একদিন অনন্য আমায় বলেছিল, ‘I am proud of my skin color. It is shiny brown.’  
আমাদের দরজার উপরে একটা ছবি চুম্বক দিয়ে আটকানো থাকে অনন্য-র আঁকা তারিখ দেয়া নেই ছবির স্টিক ফিগারের গায়ে পাতলুন পরা আর ইংরেজির অবস্থা দেখে ভাবছি হয়ত তখন অনন্য সেকেন্ড কি থার্ড গ্রেডে পড়ে স্কুল থেকে বলেছে তোমার বাবা মার এদেশে আসা নিয়ে ছবি এঁকে নিয়ে এস আর সাথে গল্প অনন্য আর্ট পেপারটাকে চারভাগে ভাগ করেছে প্রথম ভাগে মা আর বাবাকে এঁকেছে মাটি মাটি রঙের বিমর্ষ ক্যানভাস মা আর বাবা হাত ধরে আছে নীচে লেখা, ‘Once upon a time, my parents got married and wanted to find opportunity.’ দ্বিতীয়ভাগে দেখি এঁকেছে একটা প্লেনের ভিতরটা সারি সারি সীট প্লেনের পাখার পাশ দিয়ে আবার পাখি উড়ছে লেখা আছে, ‘My parents got on a plane with our dogs to travel to AMERICA.’ তৃতীয়ভাগের কাগজটায় তিনটা খোপ কেটেছে প্রথম খোপে প্রথম এসে যে টাউন হাউসে আমরা কুকুর নিয়ে উঠেছিলাম তার ছবি তার পরের খোপে আমরা যে ব্ল্যাক সুজান ফুল আর ছোট নদী ঘেরা লরা মেরীর মত এক ফার্ম হাউজে ভাড়া ছিলাম তার ছবি তৃতীয় খোপে আমাদের কেনা প্রথম বাড়ির ছবিনুড়ি বিছানো পথ আমাদের কুকুর টংসা, সিম্বার জন্য ফেন্স দেয়া এক একর জমি গ্যারাজ, রাস্তার দিকে মুখ করে সদর দরজা, রান্নাঘরের জানালা - সব, সব আছে এমন কি ছাদের উপরের ডিস এন্টিনা আঁকতেও ভুল হয় নি ছবির নীচে লিখেছে, ‘My dad, after arriving, got a software job as well as my mom. They got many houses over the ages, including the one we now own.’
চার নাম্বার ছবিটা সবচেয়ে মজার পুরো ছবিতে আলোর ঝলকানি লাল, সোনালি, হলুদ রঙে ভেসে যাচ্ছে সব আমরা চারজন দাঁড়িয়ে আছি বাবা, মা, অনন্য, লাবণ্য সকলের গায়ের রঙ বাদামি কালো চুল বাবার গায়ে হলুদ আর কমলা ডোরাকাটা হাফ হাতা শার্ট নীল রঙের জিন্সের শর্টস আমেরিকায় এসে বাবা যে আজকাল শর্টস পরছে, তাও নজর এড়ায় নি ছোট্ট অনন্য- বাবার পায়ে কমলা রঙের ক্লগ জুতা অনন্য পড়ে আছে একই রকম হলুদ আর কমলা ডোরাকাটা শার্ট তবে ফুলস্লীভ জিন্সের প্যান্টটাও ফুল পায়ে সেই একই কমলা রঙের ক্লগ জুতা মা আর লাবণ্য-এর পরনে নীল রঙের জামা হাঁটু পর্যন্ত পায়ে ম্যাচিং নীল জুতা লাবণ্য-এর পেটে আবার একটা বেশ মোটাসোটা ক্যাটক্যাটে হলুদ রঙের বেল্ট বাঁধা ছবির নীচে লেখা আছে, ‘Now our family lives happily, after my parents’ trip to AMERICA.’

অনেক জঞ্জালে জীবন ভরে তুলতে তুলতে যেন কোনদিন কিভাবে আমি এদেশে এসেছিলাম তা ভুলে না যাই  অনন্য-র আঁকা ছবিটা আমি দরজার উপর থেকে সরাই না





ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
১১ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

আজ আবার রোদ উঠেছে এই শীতের দেশে সূর্য ওঠা এক বড় খবর একবার টানা সতেরো দিন সূর্য ওঠে নি । একে বরফ, তার উপর সূর্য নেই। তাই যখন সূর্য ওঠে আমার মনে হয় সত্যি বুঝি বরফ ফুঁড়ে, মাটি ফুঁড়ে সবুজ দু’টো বীজপত্র মেলে ধরছি। মোটা, মোটা মাংসাল বীজপত্র। গাছের খাবারের ভাঁড়ারঘর। ছেলেবেলায় যে ফুলের পাপড়ি আঁকতাম তার মত দেখতে এই বীজপত্র। যদিও সবুজ রঙ।
নানা কথার ভিড়ে যে কাজ শুরু করেছিলাম তা যেন আজও ভেসে না যায় । খ্রীস্টমাস ট্রী থেকে অর্নামেন্ট খুলতে হবে
বহু বছর আমার একটা নরফোক পাইন গাছ ছিল।  প্রায় ছাদ ছুঁই, ছুঁই।  ডিসেম্বর মাস এলে সে গাছটাকেই খ্রিষ্টমাস ট্রি করে সাজাতাম আমি।  ছোট ছোট  হালকা কাঠের অর্নামেন্ট দিয়ে ।  মনে হত বেশি ভারী কিছু দিলে গাছ না ব্যথা পায়। বহুদিন ছিল গাছটা।  তারপর এক গরম কালে হঠাত মারা গেল।  তারপর থেকে এক আর্র্টিফিসিয়াল খ্রিষ্টমাস ট্রি দিয়েই সাজাতে শুরু করলাম ।  আর্র্টিফিসিয়াল খ্রিষ্টমাস ট্রি  আর্র্টিফিসিয়াল-ই দেখতে। বীভস।  কিন্তু প্রতি বছর জ্যান্ত গাছ কেটে তা দিয়ে সাজাতে কেমন যেন মনে সায়  দিত না আমার। 
অনন্য, লাবণ্য ছেলেবেলায় যে স্কুলে পড়ত, তা গ্রামের স্কুল।  সেখানে খ্রিস্টমাসের আগে , আর্ট ক্লাসে আর আফটার স্কুলে ওরা খ্রিষ্টমাস ট্রি সাজানোর জন্য অনেক অর্নামেন্ট বানাত। পরের স্কুলগুলোতে ধর্মের সাথে সংযোগ আছে এমন কিছুই করাত না।  এ দেশের  বহু প্রাইভেট স্কুলে আর সব পাবলিক স্কুলে ধর্ম নিয়ে কোন একটিভিটি করে না  যদি না তা ইতিহাস এর অংশ হিসাবে শেখানো  হয়যদি না তা  সাহিত্যের রেফারেন্স হিসাবে বাইবেলে কি আছে  বলে পাঠ্য বিষয় হয়। অথচ আমাদের  দেশের  তথাকথিত শিক্ষিত লোকজনকে দেখে আজকাল মনে হয় তারা বেশির ভাগ বুঝি মাদ্রাসা পাশ। রাস্তা ঘাটের মানুষদের পোশাক ও  ক্রমশ: অন্ধকার যুগের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যত এসব দেখি তত  গভীর ভাবে ভাবি ধর্মকে প্রতিদিনের অফিস কলিগদের সাথে  কথা বলবার বিষয় থেকে ধর্মকে  শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে , ধর্মকে পাবলিক ডিসপ্লের কবল থেকে আলাদা রেখে চলতে পারলে জীবনটা কতটাই  না এগিয়ে  যেতে পারত!
অনন্য, লাবণ্য-র ছেলেবেলার বানানো সেই সব অর্নামেন্ট আমি সব  জমিয়ে রেখেছি।  প্রায় চার্ ফুট বাই দুই ফুট দুটো বাক্স।  তা ভর্তি করে ওদের বানানো যত কুটিকাটিহেয়ারলুম নয়। বংশানুক্রমিকভাবে পরিবারের গল্প সেখানে আঁকা নেই। কিন্তু এ গুলোই ফার্স্ট জেনারেশন ইমিগ্রান্টদের নতুন গল্পকথা।
খ্রিষ্টমাস ট্রি থেকে একটা একটা করে অর্নামেন্ট  খুলে  বাক্সে তুলে রাখছি। 
একটা আংটি মাঝখানে  বড়সর মেরুন রঙের কাচপাথর। তাতে আলো পড়ে তা ঠিকরে পড়ছে চারদিকে পাশটা স্টিল দিয়ে বাঁধানো ক্লাস ওয়ানের ছোট্ট  অনন্য স্কুলের খ্রিষ্টমাস স্টোর থেকে কিনেছিল।  মামের জন্য নিয়ে এসেছিল। 'Mom, it is a steal . The teacher said it was a million dollar ring. But I only paid one dollar. I got it for you.’ প্রতি বছর আমার এই মিলিয়ন ডলার রিং আমি খ্রিষ্টমাস ট্রির একটা পাতায় সাজাই। গাছের ঝিলমিলে আলোতে আমার চোখেও এক ফোঁটা জল চিকচিক করে ওঠে। আমার অনন্য আমার জন্য আংটি নিয়ে এসেছে মাঝখানে তার বড়সর মেরুন রঙের কাচপাথর। 

      


ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
১২ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

গাছ থেকে খুলে রাখলাম ওয়ালনাট বাদামের খোলা দিয়ে বানানো অর্নামেন্ট ওয়ালনাট বাদামের খোলা বেশ বড় প্রায় ইঞ্চি দুয়েক তার ভিতর অনন্য ঝাউ পাতা গ্লু দিয়ে আটকেছে পাতার উপর সবুজ ঝিলিমিলি কাগজ দিয়ে মোড়া একটা প্রেজেন্ট রুপালি জরির রিবন দিয়ে বাঁধা আর বাদামের খোলাটা ঝুলছে লাল, সবুজ উল দিয়ে গাছের ডাল থেকে উলটুকু হট গ্লু দিয়ে লাগানো বাদামের খোলার সাথে। পিছন থেকে উঁকি দিচ্ছে সোনালি জরির মালা বড় প্রিয় এই অর্নামেন্টটা আমার
রেইন ডিয়ারের মুখ বানিয়েছে ওয়াল নাট বাদামের আর একটা খোলা দিয়ে । বসিয়েছে তাতে লাল তুলোট নাক, সাদার ভিতর গোল গোল করে ঘোরে এমন কালো রঙের মণি দিয়ে চোখ, বাদামি কান আর সোনালি জরি দিয়ে বানানো কাঠির শিং।
এই ওয়ালনাট বাদামের খোলা দেখলেই আমার ছেলেবেলার একটা প্রিয় সোভিয়েত ইউনিয়নের বই-এর কথা মনে পড়ে। “ইঁদুরছানা ও পেন্সিল”“ভোভার টেবিলে ছিল একটা পেন্সিল।” পেন্সিল দিয়ে নানা ছবি আঁকত ভোভা। শেষ পৃষ্ঠায় একটা ছবি ছিল ইঁদুরছানার। ওয়ালনাট বাদামের খোলাকে নৌকা করে জলে ভেসেছে ইঁদুরছানা। গায়ে তার লাল, সাদা পোলকা ডটের জামা। একটা বড়স র হার্ট শেপের সবুজ পাতা পাল হয়েছে নৌকার। সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেছে। “রুশি ছাপাখানার ডাস্টবিনে হারিয়ে গিয়েছে সদাসতেজ সেই বইগুলো।”* হারিয়ে গেছে অসামান্য সেই সব অনুবাদ, ছেলেবেলার বই, কাঠ বাদামের খোলায় করে দূরে হারিয়ে যাওয়া





১৫ ই  ফেব্রুয়ারি, ২০১৮
ম্যাডিসন, উইস্কনসিন

আজ লাবণ্য-এর জন্মদিন। ১৬ বছর হবে।  আমি বেকারি থেকে কেক কিনে তৈরী। যদিও হঠা লাবণ্য বলল, 'মাম, তুমি অনন্য-র জন্মদিনে যে চকোলেট কেক বানাও আমারও  তাই পছন্দ।' আমি তো অবাক। ছেলেবেলা থেকে সবসময় অনন্য-র জন্মদিনে কেক বানাই। বব দা বিল্ডার কেক, আইসক্রিম কেক, পিচ্ কেক, রাস্পবেরী কেক - কত কেকই বানিয়েছি।  আজকাল বানাই  ডাবল লেয়ার চকোলেট প্রেলাইন কেক।   অনন্য সবসময়  জন্মদিনের আগে ওই কেকের কথা বলে ।  পেকান নাট দেওয়া।  দুধ সাদা ফ্রস্টিং-এর উপরে তার  চকোলেট শেভিংস ।  আর লাবণ্য-র জন্মদিনে দোকান থেকেই কেক আনি। পনেরো  বছর ধরে তাই করছি।   কেন জানি বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে  লাবণ্য কেনা কেক পছন্দ করে।  কেন যে এমন মনে হয়েছে  তা এখন  আর মনে করতে পারছি না। পরের বছরের জন্মদিনে ওর জন্যও কেক বানাব।  এ বছর দেরি হয়ে গেছে। কাছের মানুষদেরও কত অল্পই আমরা কাছ থেকে জানি। 
আজ ঠিক করেছি সারাটাদিন ওর সাথে কাটাব। ও যা যা ভালোবাসে সব করব। অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি।  ওকেও স্কুলে যেতে দেই নি। স্কুল বাদ ওর জীবনে প্রায় হয়ই না।  ভয়ে ভয়ে রাজি হয়েছে ও।  একটু খুশিও কি হয়েছে? আমি তো খুব খুশি হয়েছি।  দুজনে মিলে লাইব্রেরি গেলাম।  লাইব্রেরি ওর খুব প্রিয় জায়গা।  বই নিয়ে গেলাম পাশের কফি শপে।  সেটাও বড় প্রিয় ওর। কিছুক্ষন বই পড়ল ওখানে  লাবণ্যআমি একটা লার্জ কফি লাতে নিয়ে বসলাম।  উপরে তার দুধ সাদা প্রিয় ফোম।   
বই পড়ে দু'জনে মিলে গেলাম পেডিকিউর করতে। সব আঁতলামো জলাঞ্জলি দিয়ে ।  ওর জীবনে এই প্রথম। ওখানে গরম পাথর দিয়ে ম্যাসেজ করল, পায়ের নখে নেলপালিশ পড়িয়ে দিল।  গেলাম মলে। নানা রকম কসমেটিক্স দিয়ে সাজতে।   "সাজগোজ করলে পড়াশোনায় গোল্লা পাবে" - আমাদের  ছেলেবেলায় মাথার ঘিলুর ভিতর ঢুকিয়ে দেওয়া এই চিন্তাটা একটু বদল করবার চেষ্টা করলাম।

তারপর চললাম লাঞ্চে '‘Pho’' খেতে। ভিয়েতনামের দোকান সাইগন নুডলস। সেখানে লাবণ্য-এর প্রিয় খাবার '‘Pho’'হালকা ব্রথের ভিতর নুডুল, মাংস। উপরে মুচমুচে, হার্বি, স্পাইসি গার্নিশ আর ধনেপাতা দেওয়া। পাশে এক টুকরো লেবু। সুন্দর সুপ।  বাইরে এখনো বরফ আছে। তুলার মত ঝরে ঝরে পড়ছে নরম ভালোবাসা। বরফ দেখতে দেখতে গরম গরম সুপ খেতে খুব ভালো লাগলো । 
 '‘Pho’' খেয়ে মুভি।   লাবণ্য-ই ঠিক করেছে দেখতে যাবে 'Wonder'আর জে পালাসিও-র লেখা উপন্যাস থেকে তৈরী এই মুভি।
দশ বছরের ছোট ছেলে অগাস্ট পুলম্যান।  Treacher Collins সিনড্রোম-এর জন্য ওর মুখটা অন্য বাচ্চাদের মত নয়। ডি এন এ-এর  অস্বাভাবিকতার জন্য ছেলেটির মুখটা বিকৃত, দুমড়ানো মোচড়ানো। দেখলে ভয় লাগে। এই সিনড্রোম ৫০,০০০ জনের মধ্যে  একটি বাচ্চার হয়।  অগাস্ট বাইরে পাবলিক প্লেসে স্পেসম্যানদের মুখের মত এস্ট্রোনট হেলমেট পড়ে ঘোরে।
এতদিন ওকে বাড়িতেই পড়িয়েছে মা। কিন্তু এবার ফিফ্থ গ্রেডে অন্য সব  বাচ্চাদের সাথে স্কুলে দেবে।  বাবা , মা-র খুব চিন্তা। পারবে তো ও সবার সাথে মিশে চলতে? অন্য বাচ্চারা শুধু খেপাবে না তো? কাছে টেনে নেবে কি? বাবা মা-র হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে।  অসহায় লাগে ওদের।  কোন বাবা মা-ই না চায় তার সন্তানেরও  একটা স্বাভাবিক জীবন হোক? ভীষণ নামকরা কেউ, ভীষণ সফল কেউ হওয়ার আগেও সন্তানের একটা স্বাভাবিক জীবন বোধ হয় সব বাবা মা-রই প্রথম চাওয়া।  নিজের বাচ্চাকে অন্যরা ঘৃণা করে, নিজের বাচ্চাকে ওরা খেলার দলে নেয় না , পাশে বসতে দেয় না - কোন বাবা মা-ই তা মেনে  নিতে পারে না।
আমি তো গাছ থেকে পাতা ঝরে গেলে কাঁদি।  পুরো মুভি আমি ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাদঁলাম।  লাবণ্য মাঝে মাঝে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল।
তবু জন্মদিনে এমন মুভি দেখতে চেয়েছে বলে আমার গর্ব হল।  কিছুটা হলেও অন্যের কষ্ট বুঝতে শিখুক। মানুষকে মানুষ বলে ভালোবাসতে শিখুক।  তার বাহ্যিক কাঠামো দেখে যেন ভুল না করে।
মুভির শেষে অগাস্ট স্কুলের পুরস্কার  বিতরণী সভায় পুরস্কার পায়। মুভিতে দর্শকের আসনের সবাই হাততালি দিয়ে দাঁড়িয়ে ওঠে। অগি-র(অগাস্ট) ভাষায় "I think there should be a rule that everyone in the world should get a standing ovation at least once in their lives. ” আমার গলার কাছটা বুজে আসে। আমিও সিনেমা হলের মধ্যে দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে থাকি। চোখ  থেকে জল ঝরছে। লাবণ্য আমার জামা টেনে সিটে বসিয়ে দেয় না।


১৬ ই  ফেব্রুয়ারি, ২০১৮
ম্যাডিসন, উইস্কনসিন

লাবণ্য যখন ছোট ছিল, ওর প্রত্যেক জন্মদিনে আমি একটা জামা সেলাই করে দিতাম। সাথে বানাতাম পুতুল। পুতুলের গায়েও দিতাম একই রকম ম্যাচিং জামা। লাবণ্য এখন ষোল বছরের হয়েছে। ম্যাচিং জামা পরে পুতুল খেলবার দিন পিছে ফেলে এসেছে। আমারও আর আজকাল সেলাই করা হয় না।




ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
৪ঠা মার্চ, ২০১৮

ঝলমলে দিন। বরফ গলে গেছে মোটামুটি। শুধু কিছু কিছু জায়গায় চাপ চাপ পুরনো বরফ। পুরো বরফ মে মাসের আগে গলবে না। উইস্কনসিন বলে কথা। শীতের জন্য সব পাতা ঝরা যে গাছগুলো এতদিন দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের ডালের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে বাড়ির কাচের জানালায় আছড়ে পড়ছে।
বাইরে গিয়ে দেখি ক্র্যাব আপেল গাছটায় ছোট ছোট কুঁড়ির মত এসেছে। পাতার কুঁড়ি। কুঁড়ি ফুটে পাতা হবে। রেড ওক গাছটারও একই অবস্থা। শীতের মরণের পর আবার জীবন। অসীম সম্ভাবনাময় এক জীবন।
বাচ্চারা যখন ছোট থাকে, বাবা মার চোখেও তেমনি স্বপ্ন থাকে। অসীম সম্ভাবনাময় এক জীবনের স্বপ্ন। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের বাচ্চাদের দেখে সেই স্বপ্নগুলো ডালপালা ছড়িয়ে বেড়ে ওঠে, প্রতিযোগিতাও বাড়ে। আমাদের দেশে ছেলেমেয়েকে ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার বানাতে না পারাটা মা, বাবার ব্যর্থতা। বাংলায় পড়ে কবিতা লেখা ছেলের ভবিষ্যত যে কত অন্ধকার তা কাকতাড়ুয়াও জানে। আমেরিকায় বাচ্চারা কি নিয়ে পড়বে তা নিয়ে বাবা মা’র চাপটা অত প্রকট নয়। তবে অন্য জোর জবরদস্তি আছে।
খুব সুন্দর দিন বলে হাঁটতে বের হলাম। আমাদের কয়েকটা বাড়ি পরেই একটা বাড়িতে LGBT ফ্ল্যাগ উড়ছে। লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার কমুনিটির ফ্ল্যাগম্যাডিসন বলে এমন প্রকাশ্যে বাড়ির বাইরে LGBT ফ্ল্যাগ ওড়ানোর সাহস আছে মানুষের। আমেরিকার সব জায়গায় এই সাহস নেই। তাও তো এদেশে মুখ ফুটে অনেক দেরী করে হলেও, জীবনের অনেক বছর পার করে হলেও মানুষেরা বলতে পারে যে সে লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল কিংবা ট্রান্সজেন্ডার । আমাদের দেশে এসব নিয়ে কথা বলা মহাপাপের পর্যায়ে পড়ে। মানুষ মুখ খুলতে পারে না। গোপনে জীবন কেটে যায় ।
আমেরিকায় চেনাশোনা বন্ধু বান্ধবদের মধ্যেও কত কথা শুনি। বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার ছেলেমেয়েরা। বাড়িতে মা মেনে নেয়নি, বাবা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনে কেটে গেছে বাকি জীবন। লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল বাচ্চাদের অবস্থা তাও কিছু ভাল। কিন্তু ট্রান্সজেন্ডার বাচ্চারা? ও ছেলে না মেয়ে? দেখতে ছেলের মত কিন্তু আসলে মেয়ে। দেখতে মেয়ের মত কিন্তু আসলে ছেলে। ট্রান্সজেন্ডার ছেলেমেয়েরা হরমোন ইঞ্জেকশন নিয়ে, সার্জারী করে ছেলে হ’তে চেষ্টা ক’রে, মেয়ে হ’তে চেষ্টা ক’রে। জীবনের বেশীর ভাগ শক্তি এভাবেই কেটে যায়। ‘এর চেয়ে ক্যান্সার হলেও ভালো হত, বলতে পারতাম লোককে। বুঝতে পারত সবাই। সমবেদনা জানাত,’ বলে ওঠে বাবা, মা। নিজের বাবা, মা’র ই যখন এই অবস্থা তখন পাড়া পড়শীর কথা আর না ভাবাই ভালো। ট্রান্সজেন্ডার বাচ্চাদের সুইসাইড রেট সবচেয়ে বেশী। এই তো সেদিন অনন্য-দের স্কুলেই একজন...
গাছটার কুঁড়িগুলোতে রোদ পড়ে সাটিনের মত পিছলে যাচ্ছে। অসীম সম্ভাবনা ওদের।



ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
২০শে মার্চ, ২০১৮
আজ ভার্নাল ইকিউনক্স উত্তর গোলার্ধে বসন্তের প্রথম দিন এখনো কিছু কিছু বরফ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও মাটিতে কান পাতলে শোনা যায় জীবনের নড়াচড়া স্নো ড্রপস্‌, ক্রোকাস, গ্রেপ হায়াসিন্থ মাটি ফুঁড়ে বের হওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছে ঝলমলে হলুদ, বেগুনি, সাদা ওদের রঙ এত দীর্ঘ শীতকালে মাটির নীচে ওরা বরফের নীচে ঘুমিয়ে ছিল মরে তো যায় নি দিন দীর্ঘ হচ্ছে কাঠবিড়ালিরা ডালে ডালে আনন্দ চারপাশে
কত সময়ই ঢেউ-এর পর ঢেউ মানুষকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় কিন্তু মানুষই পারে ভেজা বালির ভিতর আঙ্গুলগুলো দাবিয়ে দিয়ে আবার আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াতে কাদার ভিতর পদ্মফুল ফোটে কিভাবে তা কে জানে মানুষের জীবনের গল্পও পদ্মফুলের ফুটে ওঠার মত সব পঙ্কিলতাকে ছাপিয়ে উঠতে হবে এগিয়ে যেতে হবে পিছনে ফেলে সব দীর্ঘশ্বাস
বসন্তে ফুল ফোটে কত পাখিদের কত নতুন বাসা তাতে নতুন ডিম চারদিকেজীবন শুরু হোক’ ‘জীবন শুরু হোকবলে কি হুল্লোড় পড়ে গেছে চোখের জল এখানে মানায় না








ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
৭ই এপ্রিল, ২০১৮

সকাল থেকে যুদ্ধ করছি। রবিন পাখি বাঁচাতে। জানালার গায়ে ধাক্কা দিয়েই যাচ্ছে বুক দিয়ে, ঠোঁট দিয়ে। আত্মহত্যা করবে নাকি? বসন্তে ছেলে রবিনের হরমোন লেভেল নাকি ৩০০ গুন বেড়ে যায়। বাসা বানাবে। অন্য রবিন দের সাথে প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতা নিজের ছায়ার সাথেও। তাই এত ঠোকরানো জানালায়। আমার বাড়ি এসে সরষে ইলিশ খাওয়ার জন্য কড়া নাড়া নয়। জানালার ভিতর কাপড় ঝোলালাম, জানালার বাইরে রাংতা দিয়ে মুড়লাম। কড়া নাড়া বন্ধ হয়েছে।


২৩শে এপ্রিল, ২০১৮
ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
বরফ শেষ এবার বাগানে ঘুরে ঘুরে দেখবার পালা কারা এই দীর্ঘ শীতকাল পার করে বেঁচে থাকতে পারল সব গাছ তো উইস্কনসিনের বরফের কবল থেকে বেঁচে ফিরে আসে না
দেশি গাছগুলোকে ঘরের ভিতর রেখেছিলাম প্রায় নয়মাস পাশাপাশি থেকে যদি ওরা নিজেদের  উত্তাপ  দিতে  পারে এবার ধীরে ধীরে ওদের বাইরে আনতে হবে
দেখছি মাটি পর্যন্ত মরে গিয়েছিল আমার প্রিয় গোলাপ গাছ এখন আবার নতুন পাতা গজাচ্ছে মৃত্যু থেকে ফিরে আসতে কত গাছকেই দেখলাম এই উইস্কনসিনে এই গোলাপের নাম 'হেরিটেজ' ডেভিড অস্টিন রোজ চার বছর আগে আগের গ্রামের বাড়ি থেকে এনেছিলাম অসম্ভব সুন্দর গন্ধ জুন মাস নাগাদ ফুটবে অপেক্ষা করে আছি













ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
২৪শে এপ্রিল, ২০১৮
চারদিন পর অফিস আসলাম। দেখি পন্ডের সব বরফ গলে গেছে। উইপিং উইলো গাছে নতুন কুশি এসেছে। বেশ কিছু নেস্টবক্স বসিয়েছে অফিস থেকে পাখিদের জন্য। তাতে ট্রি সোয়ালো বসে আছে, বাসা বেঁধেছে। স্টার ম্যাগনোলিয়া ফুটতে শুরু করেছে। সেই সাথে ড্যাফোডিল। এমন অফিস ছেড়ে দূরে থাকা একদম উচিত নয়


ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
২৫শে এপ্রিল, ২০১৮
আজ ঝকঝকে রোদ। আমি উলের কোট আর দস্তানা যা এতদিন শরীরের চামড়ার মত হয়ে গিয়েছিল তা বাদ দিয়েই বাইরে খোঁজ খবর নিতে গেলাম। কারা বেঁচে আছে উইস্কনসিনের শীতের পর। কোন কোন গাছ। দেখি মেইলবক্সের পাশটা ঘিরে ড্যাফোডিলের কলি, ব্লীডিং হার্টের কুশি, পিওনির লাল ডগা উঁকি দিচ্ছে। আর একটা শীতকাল পার করল ওরা। মেইলম্যানও এসেছে। মেইলবক্সের ভিতর আমার জন্য আমাজন থেকে গাছের বীচি। পিয়ার শেপের হলুদ রঙের হেয়ারলুম চেরি টমেটোর বীচি এসেছে। আর এসেছে হ্যাভেনলি ব্লু মর্নিং গ্লোরি। লেখা আছে soak overnight and plant 1/2 " deep. ওভারনাইটের ধৈর্য আমার স্বভাবে কুলালে হয়!
বোঝাই যাচ্ছে বসন্তকাল এসে গেছে। আমি গাছপালা নিয়ে খুব উত্তেজিত। দেখি ঘরের ভিতর রাখা ফার্নটার পাশ থেকে আর একটা গাছ গজিয়েছে। প্রাণে ধরে তাকে কেটে আর একটা টবে দিলাম। ওমা একি? মাটিতে শামুকের মত পেঁচিয়ে, মাথাটা সাপের মত ফনা তুলে ও কে? ফার্নের পাতা হওয়ার আগের অবস্থা। একেই বুঝি ফ্রন্ড বলে?
শীতকালে বরফ বন্দী হয়ে আমার পেশা ছিল নেট ঘুরে ঘুরে কোন গাছ কিনব, কোন পট কিনব, কোন পট হোল্ডার কিনব তা দেখা। একটা ছোট ট্রাই সাইকেল পট হোল্ডারের উপর অনেক দিন থেকে লোভ। আজ পেলাম। বসবার ঘরে সাজিয়ে রাখলাম ফুটন্ত হাস্নাহেনা দিয়ে। ভাবছি যখন যে গাছে ফুল ফুটবে তাকে এনে তখন এখানে রাখব। অতিথিরা খুশী হবে?



ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
২৬শে এপ্রিল, ২০১৮
ভাবা যায় মেনার্ডসের মত হার্ডওয়্যার স্টোর রজনীগন্ধার টিউবার বিক্রি করছে? কাল গিয়ে হতবাক হয়ে গেলাম আগে একবার আমাজন থেকে রজনীগন্ধার টিউবার কিনেছিলাম অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল ওরা ইন্ডিয়াতে অর্ডার পাঠিয়েছিল রজনীগন্ধার সাথে সাথে কিনেছি বেগুনি রঙের ডিনারপ্লেট ডালিয়া ছয় থেকে দশ ইঞ্চি সমান নাকি ফুল হবে লোহা পেরেকের দোকান যে ফুলগাছ বিক্রি করল তা ভালোভাবে মনের ভিতর করাতের কড়া দাগ রেখে যাবে নিশ্চয়
কাল ভিজিয়ে রেখেছিলাম অপরাজিতার বীজ আমার প্রিয় বন্ধুর নামে নাম এই ফুলের। কত কষ্ট করে দেশী ফুলের গাছ জোগাড় করি! শীতকালে মাটি ফ্রীজ করে এখানে ডিপ ফ্রীজে রাখা মুরগির মত হয়ে যায় সেই মাটি নরম হয়েছে আর দেরী করা ঠিক নয় স্বপ্নের নীল অপরাজিতার বীজ পুঁততে যাই মাটি অপেক্ষা করছে





ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
২৭শে এপ্রিল, ২০১৮


জিফি ট্যাবলেট এসে পৌঁছেছে। এখন এদের জলে ডুবিয়ে মোটাসোটা করে বীজ গুঁজে দেব। মাথায় সাদা প্লাস্টিকটা দিয়ে ঢাকা দেব। আশা করি দিন সাতেকের মধ্যে চারা গজিয়ে যাবে। বেগুন, লাউ, শশা, একর্ন লাগাচ্ছি। ভীষণ আনন্দ হচ্ছে।
' মাস ঘরে বন্দী ছিল আমার লাল শাপলা। জালি জালি টবে পুঁতে আর একটা বড় টবে জল দিয়ে রেখেছিলাম। দশ পয়সা সাইজের পাতা নিয়ে তবু বেঁচে আছে সে। এখন বাগানের ছোট পন্ডটায় দেব।
সাগরী আপা সুস্মির সাথে একটা হাস্নাহেনার ডাল দিয়েছিলেন আমার জন্য প্লেনে চেপে নিউ ইয়র্ক থেকে সে ডাল এসেছিল উইস্কনসিন। অনেক বড় হয়েছে সেই গাছ। ঝেপে ফুল এসেছে। ঘরের ভিতরই। বসবার ঘরে রেখেছি টবটা। বাড়িতে যেই আসছে, পটল তুলছে।


ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
২৮শে এপ্রিল, ২০১৮
আজ বেশ কিছু গাছের বীজ লাগিয়েছি, মাটি খোঁড়াখুঁড়ি করেছি কাদা মাখা হাত আর শরীরে বসন্তকালের রোদ
গ্যারেজে নানা টব টানাটানি করতে গিয়ে চোখে পড়ল আমার প্রিয় সেই ছোট্ট ফ্লাওয়ার পট চায়ের কাপের মত সাইজ ভীগান পটারির এই গত মাস পর্যন্তও আমি ভীগান ছিলাম ফুলের মধুও খেতাম না ভীগান পটারির চায়নাতে বোন বা কোন এনিমেল প্রোডাক্ট মেশায় না কত খুঁজে যে বের করেছিলাম পটটা দুধ শাদা তাতে ছোট ছোট গাঢ় নীল ফুল আর লতা রিমের কাছটা যেন সোনালি জড়িতে মোড়া গরমকালে আমি ধনেপাতা করতাম পটটায় ধনেপাতার ঢেউ খেলানো ধারের সাথে ম্যাচ করত আমার পটের ঢেউ খেলানো সসার উজ্জ্বল সবুজ রং শাদা আর নীলের সাথে মানাতও খুব
সেই প্রিয় পট আমার হাত ফসকে মাটিতে পড়ে তিন টুকরো হয়ে গেল আজ শুনেছি চিনামাটির পাত্রে চির খেলে তা আর জোড়া দেওয়া যায় না কোনদিন দাগ থেকে যায় ঠিক যেমন মানুষের সম্পর্কে এসব উড়ো কথায় কান দেই না আমি সুপার গ্লু দিয়ে জীবনের সব কানাগলির ফাটল সারিয়েছি আমি আমি যে মানুষ ভালোবেসেছি, যে ফুল, যে পাতা তারা ইচ্ছে করলেও কি আমায় ভালো না বেসে পারবে? তাদের চোখে জল আছে না?


ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
২৯শে এপ্রিল, ২০১৮
রবিবার সকাল আমার সকাল যদিও হল বেলা এগারোটার সময়! রান্নাঘর থেকে এই সাত সকালে হাতা খন্তার শব্দ ভেসে আসছে গিয়ে দেখি অমল সম্বার বানাচ্ছে আমার প্রিয় সজনে ডাঁটা কাউন্টার টপের উপর পড়ে আছে পরীক্ষামূলক পরিকল্পনা এ ধরনের কাজ যখন হয়, তখন রান্না ধারে ম্যানেজ হওয়ার আনন্দে আমি আত্মহারা হয়ে পড়ি অমল আমায় বলল, 'কটা কারি পাতা দাও তো' আমার গাছ গাছালি যে কারো সত্যিকারের কাজে আসতে পারে তা জেনে আপ্লুত হয়ে উঠলাম আমি নিজে থেকে গাছের টমেটো, বীন বাড়ির সদস্যদের গছিয়ে দেই সে একরকম আর এ যে এক পরম নিশ্চিন্তি ভাব কোনদিন আমার গাছপালা তাকিয়ে দেখে না যে মানুষ, সে কিভাবে জানল আমার কাছে কারিপাতা থাকবে?
এই গাছটার বয়স পনেরো বছর চারাটা নিউ ইয়র্ক থেকে প্লেনে চেপে আমার এই বরফ মোড়া উইস্কনসিনে এসেছিল বাড়ি বদল হয়েছে ট্রাকে চেপে নতুন বাড়িতে এসেছে কারিপাতা সামারে শুধু মাস তিনেক বাইরে গিয়ে সত্যিকারের রোদ লাগিয়েছে গায়ে তারপর কাচের জানলার বাইরে বরফ ঝড় বয়ে গেছে কাচের মাঝ দিয়ে যে সূর্যের আলোটুকু আসে তাতেই স্নান করেছে কারি পাতা মাথার উপর আর্টিফিসিয়াল আলো ঘরের ভিতরই মুখ বুজে বেঁচে থেকেছে আর আমি সুগন্ধী পাতাগুলোর দিকে তাকিয়ে শুধু অবাক হয়ে ভেবে গেছি যেখানে বাঁচবার কোন কথাই নয়, সেখানেও জীবন কী অদ্ভুতভাবে বেঁচে থাকে প্রতিকূলতায় বেঁচে থাকে মানুষ, গাছ, ফুল, পাখি, নদী



ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
৩০শে এপ্রিল, ২০১৮
আজ সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখি প্রিয় বন্ধু বলছে ওর ফিকাস গাছটা ছয় সাত বছর হয়ে গেল, বাড়ছে না, এবার ওটাকে বনসাই করে ফেলবে। বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠল। প্রিয় বন্ধু। তাকে কিভাবে না বলি? কষ্ট পাবে না? শেষমেষ বলেই বসলাম, ‘বনসাই দেখলে খুব কষ্ট হয় আমার। যেন তাকে বাড়তে দেওয়া হয় নি। এই যে কথাটা বললাম তাতে গাছটার জন্য ভালো লাগল, কিন্তু বন্ধুর মনে কষ্ট দেওয়ার জন্য মন খুব খারাপ হয়ে  গেল। আমার ঝান্ডা, আমার মতবাদ অন্যর উপর চাপিয়ে দেওয়া কি ঠিক? এমন হয় আমার সব সময়। আমি নিজে সার্কাসে যাই না, চিড়িয়াখানায় যাই না। কিন্তু বাড়ির ছেলেমেয়েরা যখন হুল্লোড় করে যায় ওদের আমি বলতে পারি না, ‘ওখানে প্রাণীদের সাথে ঠিকমত ব্যবহার করা হয় না। ওখানে যেতে নেই।অথচ মতামত যদি না দেই, কোন পথটা যে ঠিক সেই বা খুঁজে পাব কি করে? আমি ডানপন্থী না বামপন্থী তা কাউকে জানানো কতটা জরুরি? কিন্তু কারো মনে কষ্ট না দিয়ে কি মত বদলানো যায়? দেশে থাকতে আমি কেমন যেন একটু জংলিমত ছিলাম। অনায়াসেই বন্ধুদের বলতাম, ‘এ মা, কী ক্যাটক্যাটে হলুদ রঙ্গের জামা পড়েছিস তুই!’ বন্ধুর মনটা যে খারাপ হয়ে গেল তাও বুঝতাম না। এদেশে দেখি একটা কথা খুব চলে। ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট।' যত মানুষকে পার ইনক্লুড করতাই ‘মেরি খ্রীস্টমাস’ না বলে পলিটিক্যালি কারেক্ট মানুষেরা বলে, ‘হ্যাপি হলিডেইস’। খুব ভালো লাগে আমার এটা। কাউকে নীচু কর না। বুকে টেনে নাও। যতটা পার। গত প্রায় সাত বছর আমি ভীগান ছিলাম। কিন্তু আমার অনেক বন্ধু আছে যাদের বাড়ি ভীগান খাওয়ার ব্যবস্থা তো দূরের কথা, খুব একটা নিরামিষও রান্না হয় না। সেই বন্ধুদের বাড়ি ‘না  না আমার জন্য কোন আলাদা ঝামেলা করতে হবে না’ বলে খাসীর মাংস দিয়ে ভাত খেয়ে উঠে এসেছি আমি। এটা কি ঠিক ছিল? এটা কি ভুল ছিল? ‘খ্যাঁপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশপাথর!'
আমারও একটা ফিকাস গাছ আছে। অনন্য-এর বেবি শাওয়ারে অমল দিয়েছিল আমাকে। সামনের মাসে অনন্য আঠারো বছরের হবে। তার মানে এই গাছের বয়সও আঠারো আঠারো বছরেও বাড়েনি এই গাছটাও একটুও। এক দিক দিয়ে ভালো।
তার মানে হয়ত এ ফিকাস তিনশ বছর বাঁচবে তাই ধীরে ধীরে বাড়ছে আসলে মায়ের মন কুসংস্কারে ভরা গাছ তো অনন্য-র নামে পেয়েছি কিন্তু যদি গাছটা না বাঁচে?যদি গাছের ডাল ভেঙ্গে যায়? ক্ষতি হবে অনন্য-? বালাই ষাট
আমার আর এক বন্ধু আছে, ও প্রথাগত সবকিছু থেকে আলাদা কিছু করে বড় ভালোবাসি ওকে ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে এখানে স্কুলে তো রমরমা ব্যাপার ক্লাশের বাচ্চারা নিজেদের মধ্যে চকলেট, কার্ড, কাগজের ফুল এইসব দেওয়া নেওয়া করে একাকার আমার বন্ধুর ছেলে অনন্য-র সাথে পড়ে আমার বন্ধু তথাকথিত চকলেট দেওয়ার পক্ষপাতী নয় ছেলের সাথে বসে ও ক্লাশের সব বাচ্চাদের জন্য হাতে গড়া উপহার বানাল একটা খুব নরম মেরিনো উলের থ্রেড আর তাতে ফেল্ট কেটে একটা করে হার্ট শেপের লকেট আমি আমার গাছ নানা রকম অর্নামেন্ট দিয়ে সাজাই অনন্য -র ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র উপহার পাওয়া এই মালাটা আমার ফিকাস গাছের গায়ে ঝুলিয়ে দিলাম শতায়ু হও গাছ শতায়ু হোক ভালোবাসা
১লা মে, ২০১৮
ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
উইস্কনসিনে খুব বেশি ম্যাগনোলিয়া ফোটে না স্টার ম্যাগনোলিয়া ফোটে খুব ছোট গাছেই সবচেয়ে বেশি উচ্চতা পনেরো ফুট মত শাদা তারার মত ফুল গাছে কোন পাতা নেই হীরার কানের টবে সোনা দেখা না গেলেই বা কী? আগের গ্রামের বাড়িতে স্টার ম্যাগনোলিয়া লাগিয়েছিলাম বসন্তের শুরুতে গাছটার দিক থেকে চোখ ফেরানো যেত না কিন্তু বসন্তের হঠাত ঝরো বাতাসে বা আচমকা ফ্রস্টে একদিনের মধ্যে ঝরে গেছে বহুবার পুরো গাছ ভর্তি ফুল এক বন্ধু বুদ্ধি দিয়েছিল মোজা পড়িয়ে রাখতে সব ফুল গুলোকে আমার ভালোবাসা ফুলকে মোজা পড়ানোর মত পাগলামোতে পৌঁছায় নি ফলে আমার গাছে ঝরে গেছে ফুল আমার অনেক রাখতে না পারা কথার মতই
স্টার ম্যাগনোলিয়ার পর চেষ্টা করলাম বেটি ম্যাগনোলিয়া লাগাতে পুরোনাম এলিজাবেথ আদর করে বেটি অনন্য লাবণ্য কে তখন খুব ভালো একটা ইলিমেন্টারি স্কুলে দেব বড় শখ ঈগল স্কুল আমরা অমন স্কুলে পড়তে পারিনি বলে বাচ্চাদের মাঝ দিয়ে স্বপ্ন সফল কিন্তু দেব বললেই কি দেওয়া যায়? পরীক্ষা আছে, রেকমেন্ডেশন আছে, ইন্টারভিউ আছে এদিকে আমরা আমেরিকার গ্রামে থাকি কাউকে চিনি না অনন্য লাবণ্য পরীক্ষা দিয়ে উতরে গেল স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল বেটি ওদের ইন্টারভিউ নিল, রেকমেন্ড করল আমার গলার কাছটা ভারী হয়ে এল চোখে জল বাড়ি এসেই খুঁজেপেতে ওর নামে নাম বেটি ম্যাগনোলিয়া কিনে আনলাম আমার প্রিয় মানুষদের নামে গাছ পেলেই আমি সে গাছটা লাগানোর চেষ্টা করি এই তো সেদিন কিনে এনেছি লাল রঙের এক প্যাশন ফ্লাওয়ার ওর নাম মার্গারেট অনন্য লাবণ্য-এর পিয়ানো টিচারের নামও মার্গারেট আমার বড় বন্ধু ওকে আমি চিরদিন মনে রাখতে চাই
এখন বেটি ম্যাগনোলিয়া গাছটায় কলি এসেছে গোলাপি লাল রঙের কলি আমি মনে করছি বেটির কথা কয়েক বছর আগে ও ক্যান্সারে মারা গেছে



৪ ঠা মে, ২০১৮
ম্যাডিসন, উইস্কনসিন

লাগে না গো কেবল যেন কোমল করুণা,
মৃদু সুরের খেলায় এ প্রাণ ব্যর্থ কোরো না।
জ্ব’লে উঠুক সকল হুতাশ, গর্জি উঠুক সকল বাতাস,
জাগিয়ে দিয়ে সকল আকাশ পূর্ণতা বিস্তারো।।’
সকাল থেকে গুন গুন ক’রে এই কটা লাইন গাইছি। রবিঠাকুরের গান আমার কাছে প্রার্থনার মত। বুকের ভিতরটা নিংড়ে চোখের জল হ’য়ে নামে।
আমার বিছানার উপর 'I am Malala ' বইটা পড়ে আছে  বইটার উপর বসন্তের রোদ এসে পড়েছে 
"কে মালালা?" স্কুলবাসে অন্য মেয়েরা কিছু বলে না শুধু কয়েকজন মালালার দিকে তাকায় মালালাই একমাত্র মেয়ে যার মুখ পর্দায় ঢাকা নয় মালালা ওর বাবাকে বলেছিল, 'আমার মুখ আমি কোনোদিন পর্দায় ঢাকবো না ' চারপাশের নিকাব পড়া, বোরখা পড়া পাকিস্তানী  মেয়েদের মাঝে নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে বাবা  সায় দিয়ে বলেছিলেন, 'হ্যাঁ, আমার মালালা হবে পাখির মত স্বাধীন ' মালালাকে চিনতে পারার সাথে সাথে তালিবানের বন্দুক থেকে সরাসরি গুলি ছুটে আসে মালালাকে লক্ষ্য করে  মাথায় গুলি লাগে  পনেরো বছর বয়স তখন মালালার  সেটা ২০১২ সাল 
মালালা ইউসাফজাই বিশ্বের কণ্ঠ প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে মালালার গুলি খাওয়ার খবর পেয়ে মালালার মুখ বিকৃত হয়ে গেছে । চেনা যায় না ওকে । পাকিস্তানের পেশোয়ার, রাউয়ালপিন্ডি হয়ে শেষমেষ ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হয় মালালাকে হয় খুলিতে সার্জারি বিকৃত হয়ে যাওয়া মুখ আর আক্রান্ত মাথার খুলি আবার জোড়া লাগানো হয় । কিন্তু মালালার সেই হাসি আর কোনদিন সেই আগের মত হবে না ।
২০০৯ সালে যখন তালিবানদের দখলে সোয়াত উপত্যকার জীবন কেমন তা নিয়ে বিবিসি উর্দূর জন্য ছদ্মনামে এক ডায়েরি লেখে, ঠিক তখন জনসমক্ষে আসে মালালা মেয়েদের পড়াশোনার উপর তালিবানি ফতোয়াকে  কেন্দ্র করে করা এক ডকুমেন্টারি-র প্রধান চরিত্র মালালা  ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫ সালের সংখ্যায় টাইম ম্যাগাজিন মালালাকে নিয়ে লেখা প্রকাশ করে মালালাকে বর্তমান পৃথিবীর একজন অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসাবে উল্লেখ করে   এই স্কুলে পড়া ছোট মেয়েটি তালিবানদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মেয়েদের  শিক্ষা আর নারীদের অন্যান্য অধিকারের বিশ্বজোড়া  মুখপাত্র হয়ে দাঁড়ায়   ২০১৪ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পায় মালালা  নোবেলপ্রাপ্তদের মধ্যে মালালা-  বয়সে সবচেয়ে ছোট মালালার জন্মদিনের দিন ১২ই জুলাই বিশ্ব মালালা দিবস হিসাবে ঘোষণা করেছে জাতিসংঘ । মেয়েদের শিক্ষার অধিকার নিয়ে সচেতনতা বাড়ানই এই দিনের কাজ ।  পৃথিবীর স্কুলে যায়না এমন বাচ্চাদের এক তৃতীয়াংশের-  বেশি বাস করে যুদ্ধ  অধ্যুষিত অঞ্চলে সিরিয়ার সমস্যা  পৃথিবীর এক অন্যতম সমস্যা সিরিয়ার  এই রিফুজি বাচ্চাদের জন্য এক বৃহ অংশ আসছে আজ  নোবেল প্রাইজ প্রাপ্তির  মালালা ফান্ড থেকে  ইংল্যান্ডের  অক্সফোর্ড-এ মালালা এখন দর্শন, রাজনীতি আর অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করছে  তার পরিবারের পাকিস্তানে ফেরা নিরাপদ নয়  
মালালা নামটা এসেছে মালালাই নামে এক আফগান মহিলা মুক্তিযোদ্ধার নাম থেকে বাবা জিয়াউদ্দিনেরই রাখা  প্রথম থেকেই জিয়াউদ্দিন সোয়াত উপত্যকার অন্য যে কোন মেয়ের থেকে আলাদাভাবে বড় করে তুলছিলেন মালালাকে পাকিস্তানে যখন ছেলের জন্ম হয়, আনন্দের জোয়ার বয়ে যায় পরিবারে অথচ মেয়ের জন্ম হলে কেউ দেখতে আসে না সে বাচ্চা মায়ের জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে মহিলারা পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকায় শুধু পুরুষদেরই স্থান বংশলতিকায় কিন্তু  জিয়াউদ্দিন নিজেদের পরিবারের বংশলতিকায় যোগ করলেন মালালার নাম  তিনশ বছরের মধ্যে এই প্রথম যোগ হল কোন মেয়ের নাম  প্রচলিত নিয়মের বিরুদ্ধে সবসময়ই জিয়াউদ্দিন   বাবার প্রতিষ্ঠিত স্কুলে যেত মালালা যে দেশে মেয়েরা বাজারে জিনিষের দাম পর্যন্ত পড়তে পারে না, সেখানে অন্যান্য মেয়েদের সাথে মালালা গুণ অঙ্ক করত যে দেশে মেয়েরা একজন পুরুষ সাথে না নিয়ে রাস্তায় বের হয় না, সেখানে বই-এর পাতায় সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়াত জিয়াউদ্দিনের স্কুলের এই মেয়েরা বিতর্কসভায় যোগ দিত মালালা জিয়াউদ্দিনের প্রাণ মালালা

তালিবানরা আসবার পর থেকে শান্ত, অপরূপ সোয়াত উপত্যকার চেহারা পাল্টে যায়  গান গাওয়া নিষেধ, নাচ তো নয়ই  মেয়েদের পড়াশোনা নিষেধ মেয়েরা শুধু ঘরে থাকবে বুদ্ধর মূর্তি ভেঙে ফেলা হল চারদিকে  অন্য কোন ধর্মের অস্তিত্ব থাকা যাবে না  শিল্প সংস্কৃতির ধ্বংসাবশেষ পড়ে থাকলো  তালিবানরা মানুষ মেরে  চত্বরে ফেলে রাখত যেন  সবাই প্রতিদিন সকালে উঠে দেখতে পায় তালিবানদের বিরোধিতা করবার ফল কি  
যখন তালিবানরা সোয়াত উপত্যকা-তে আসে, তখন মালালার বয়স দশ অদ্ভুত চেহারার মানুষ এরা  লম্বা, অপরিচ্ছন্ন, নোংরা চুল আর দাড়ি  ক্যামোফ্লেজ ভেস্ট পড়া সালোয়ার  কামিজের
উপর
'কিভাবে তালিবানরা আমার শিক্ষার মৌলিক অধিকার কেড়ে নিতে পারে?’ ২০০৯ সালে মালালার  প্রশ্ন   যা প্রচারিত হয়েছিল অঞ্চলের সব খবরের কাগজ আর টেলিভিশন চ্যানেলে
আমি তালিবানদের  বিরুদ্ধে   ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে এখানে কথা বলতে আসি নি  আমি শুধু বলতে চাই  শিক্ষা প্রতিটি শিশুর মৌলিক অধিকার  আমি এমন কি তালিবান এবং সব সন্ত্রাসকারীদের ছেলেমেয়েদের জন্যও শিক্ষা চাই' ‘সন্ত্রাসকারীরা ভেবেছিল তারা আমার লক্ষ্য আর উদ্দেশ্য বদলে দেবে, আমার আশাকে  গলা টিপে হত্যা করবে, কিন্তু আমার জীবনে কিছুই বদলে যায় নি  শুধু দুর্বলতা , ভয় আর আশাহীনতার মৃত্যু হয়েছে আর তার বদলে শক্তি আর নির্ভিকতার জণ্ম হয়েছে 

লাবণ্য বইটা  পড়ে শেষ করেছে  লাইব্রেরিতে এবার  ফেরত দিতে যেতে হবে  লাইব্রেরির পথে অনেক ঝলমলে হলুদ ড্যাফোডিল ফুটেছে ড্যাফোডিলের বাল্ব বিষাক্ত বলে কাঠবিড়ালি, ইঁদুর কেউ খেয়ে যায় না  এক বছর লাগালে বছর বছর ওরা বেড়ে যায়  সোনালি আশা পৃথিবী দখল করে ফেলে  আমি ভাবি মানুষেরও স্বর প্রতিবাদী হওয়া উচিত মানুষ হিসাবে বিষাক্ত না হলেও এমন হওয়া  কখনোই উচিত নয় যে সে  নিজের কথাটুকুও জোরে বলতে পারে না, তার  গলার স্বর  কেউ শুনতে পায়  না  এ পৃথিবীতে  বেশি নরম, বেশি ভালো মানুষদের সুযোগ পেলেই মাড়িয়ে চলে যায় তারা যাদের পায়ে বুটজুতো আছে  অথচ নরম মানেই যে সে দুর্বল  তা কিন্তু নয় 

আজ আমার জন্মদিন জন্মদিন নতুনভাবে  বাঁচবার দিন দৃঢ়ভাবে বাঁচবার  দিন আর একবার জীবনকে আঁকড়ে ধরবার দিন  নিজের ভিতর যখন আনন্দের সব উ  ফুরিয়ে যায়, তখন জন্মদিন নতুনভাবে নিজেকে আলোর কণা করে সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার দিন 

মালালার মাথার খুলির যেখানে বুলেটে ফুটো হয়ে  গেছে  সেখানে  টাইটানিয়াম প্লেট লাগানো হয়েছে কিন্তু  মলাটের উপর,  মালালার হাসিটা আজও সংক্রামক আমিও অল্প  হাসলাম আর তারপর  হাতের দু মুঠোর ভিতর শূন্য থেকে খাবলে ধরে জীবন ভরে ফেললাম 
৫ ই মে, ২০১৮
ম্যাডিসন, উইস্কনসিন

আজ অনলাইন স্টোর আমাজন থেকে মাধবীলতা-র বীজ এসেছে বাদামি রঙের ছোট ছোট কামরাঙ্গার মত দেখতে কিভাবে লাগাব?

তবে এতকাল যাকে মাধবীলতা বলে জেনে এসেছি, সে জানাটুকুয় ভুল ছিল, এর নাম মধুমঞ্জরী রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন উইস্কনসিনে যদি সত্যি সত্যি মধুমঞ্জরী ফোটাতে পারি, আমার সব ধরণের সব মন খারাপ ঝড়ের পাতার মত উড়ে যাবে














৬ ই  মে, ২০১৮
ম্যাডিসন, উইস্কনসিন

বাড়ির সবাই চীনাম্যান হবে বলে বেশ কিছু চপস্টিক কেনা হল একবার এখন দেখি খুব কদাচিত বের হয় তারা দুই বছরে একবার গায়ে খুব সুন্দর ছবি আঁকা আজ তিনটাকে গাছ ঠ্যাকা দেওয়ার কাজে লাগিয়ে দিলাম কাজে এল!


৯ ই মে, ২০১৮
ম্যাডিসন, উইস্কনসিন

চারদিকে এখন রেডবাড ফুটছে বসন্তের দূত খুবই নরম মত এই ফুল বেগুনি আভা মেশানো গোলাপি রঙ প্রায় তিরিশ ফুট লম্বা হয় এই গাছ অনন্য-র জন্মের সময় অনেক ফুটেছিল রেডবাড অনেক প্রজাপতি আসে এই ফুলে
আজ অনন্য-র আঠারো বছর হল আমার প্রাণের ঠাকুর রবিঠাকুরের জন্মদিনে জন্মদিন ওর
উদয়দিগন্তে শঙ্খ বাজে, মোর চিত্ত মাঝে
চির নূতনেরে দিল ডাক
পঁচিশে বৈশাখ।।
মহামানবের জন্মদিনে জন্মদিন বলে আমার মনে হয়েছিল আমি বুঝি অমরাবতীর ছোঁয়া পেয়ে গেছি সি সেকশনের সব ব্যথা ভুলে গিয়েছিলাম

হাসপাতালে অনন্য-র ছোট ছোট পায়ের ছাপ দেওয়া একটা কাগজ দিয়েছিল সে ছাপ চিরদিনের মত সেদিন আঁকা হয়ে গিয়েছিল আমার হৃতপিন্ডের উপর

শুনেছি রবিন পাখি যখন জীবনের প্রথম ডিম পাড়ে তখন নীলচে সবুজ ব্লু স্প্রুস-এ বাসা বাঁধে আকাশের নীল আর প্রকৃতির সবুজে বুঝি এক ক্যামোফ্লেজ হবে , কেউ জানতে পারবে না কোথায় ডিম পাড়া হল প্রথম সন্তান নিয়ে আমারও সতর্কতা কিছু কম ছিল না
এখানে দেখি বাচ্চাদের গারবার-এর জারের বেবি ফুড খাওয়ায় সবাই আমার মনে হয়েছিল যদি তাতে কিছু ক্ষতি হয়! অর্গানিক আপেল, গাজর আর পিয়ার্স কিনে স্টিম করে তা পিউরি করে সাথে সাথে খাওয়াতাম আমি দেরি হলেই খাবারের গুণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে পোর্টল্যান্ড বোনের বাড়ি যাওয়ার সময় সুটকেসে করে আপেল, গাজর নিয়ে গেছি যদি কিনতে দেরি হয় নিয়ে গেছি ছুরি, পিলার যদি জার্ম লেগে থাকে ওদেরটাতে কিছু আমার বোন অসীম ক্ষমাশীল বলে কিছু মনে করে নি
একদিন ভোর চারটায় ইংল্যান্ড থেকে ফোন পড়িমরি ফোন ধরতে গেলাম এদিকে মাত্র চোখ লেগেছে সারারাত দুই ঘন্টা পর পর অনন্য-র সাথে জেগে কি ব্যাপার? নাহ, আমেরিকায় কুলায় নি অনন্য-কে খাওয়ানোর জন্য ইংল্যান্ড থেকে কাপ অর্ডার করেছি এই কাপগুলো ভারী ভালো লাল রঙের কাপ গরম খাবার দিলে হলুদ হয়ে যায় ফলে বাচ্চার ঠোঁট পুড়ে যাবে না তবে এ কাপের-ও গল্প আছে সে বছর অনন্য-কে নিয়ে দেশে গিয়েছিলাম আসানসোলে আমার শ্বশুর বাড়ি কিন্তু আসানসোলের গরমে কাপ তো সারাদিন হলুদ হয়ে থাকে কি করি ? খাওয়ানোর আগে কাপ ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখি কাপ লাল হয় তারপর বের করে খাবার দেই এবার চোখ রাখা যেন হলুদ না হয় কাপ কত যে কান্ড
ছেলেবেলায় খুব দুর্ঘটনা ঘটেনি অনন্য-র জীবনে একবার সিঁড়ির কাঠের রেলিং-এর ফাঁকে মাথা ঢুকিয়ে ফেলেছিলো মা তখন আমাদের কাছে মা'র সে তো কি ত্রাহি চিকার সিঁড়ি কেটে ফেল সিঁড়ি কেটে ফেল আর একবার ফায়ারপ্লেসের ইঁটে মাথা ঠুকে কপালে স্টিচ সবাই বলল হ্যারি পটারের মত লাগছে আমার কি ভীষণ মন খারাপ আমার বাচ্চার শরীরে খুঁত হয়ে গেল আসলে অনন্য বলতে গেলে আমার থেকে অনেক শান্তই ছিল দিদার কাছে শুনেছি আমি নাকি চার তলার উপর থেকে দুই বছর বয়সে ট্রাই সাইকেল চালিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়েছিলাম তারপর আর কি? চিপটাং !
হলুদের প্যাকেট ছিঁড়ে চোখে মুখে ঢুকিয়ে এক সা করেছিলাম আর একবার হসপিটালে দৌঁড় দৌঁড় দিদা বললো ডাক্তার নাকি বলেছিল হলুদ বলে রক্ষা, লঙ্কার গুঁড়ো হলে অন্ধ হয়ে যেত বাচ্চা
জন্মের পর পর অনন্য- Apgar স্কোর মাপা হয়েছিল নবজাতকের হার্ট রেট, শ্বাস-প্রশ্বাস , মাসল টোন, চামড়ার রঙ ইত্যাদি মাপা হয় এই স্কোর দিয়ে অনন্য- Apgar স্কোর এসেছিল ৯ আমার কাছে সেই Apgar স্কোর তখন কর্ণেল , প্রিন্সটনে চান্স পাওয়ার থেকেও বেশি দামি ছিল বুঝতে পারি নি ছেলেবেলার সেই Apgar স্কোর পিছনে ফেলে রেখে এসে একদিন অনন্য বড় হয়ে যাবে ওকে জীবনের অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হবে, যা আমি চেষ্টা করলেও বদলাতে পারব না এমন ও হবে যে একদিন আমি আর এই পৃথিবীতেই থাকবো না ওকে আগলে রাখবার জন্য যত অসহায়ই লাগুক এটাই সত্য অথচ মা বলেই কিনা জানি না অনন্য-র গায়ে একটু আঁচড় লাগলেই আমি ভীষণ অস্থির হয়ে পড়ি মা পাখিকে দেখেছো না? ঠিক তেমন যদি অনন্য-কে তুলায় মুড়ে রাখতে পারতাম!
অনন্য-ও আমার মতনই নাস্তিক হয়েছে তাই ওকে ঈশ্বরের হাতে দিতে পারছি না
অনন্য,
তোমার অন্তরের আলোতে তুমি আলোকিত হও এই কামনা করি জীবনে বিজয়ী হও
~ মাম


১০ই মে, ২০১৮
ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
ছেলেবেলায় যেমন স্ট্যাম্প কালেক্ট করতাম, বড়বেলায় সেভাবে কালেক্ট করে চলেছি দেশী গাছ আমেরিকায় বসে যখন আমার দেশের গাছে ফুল ফোটে, নিজেকে বিজয়ী মনে হয়  আজ জোগাড় করেছি বেগুনি রং-এর ভিংকা(নয়নতারা) এর গোলাপি রঙ-এর ভার্সনটাকে দিদা শ্যামসোহাগী বলে ডাকত রাজশাহী বাড়ির বারান্দায় আগাছার মত ফুটে থাকত এই ফুল দিদার ছোট পিতলের থালা, গ্লাস ছিল কৃষ্ণ ঠাকুরকে দেওয়ার জন্য প্রতিদিন তাতে দেওয়া হত চিনি, জল আর পায়ে শ্যামসোহাগী ফুল ঠাকুরের কপাল ভালো থাকলে পেত বাতাসা, নকুলদানা, কদমা কলা অবশ্য পেত অনেক বহু বছর পর এই বিদেশ, বিভুঁই-এ শ্যামসোহাগী ফুল দেখে খুব দিদার কথা মনে হল মানুষ চলে গিয়েও কতকিছু রেখে যায়




১২ই ই মে, ২০১৮
ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
গাছের নীচের ছায়ায় কিছুই গজায় না ঘাস তো নয়ই সাহায্যে এগিয়ে এল গ্রাউন্ড কভার নাম সুইট উডরাফ মিষ্টি গন্ধ আছে বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে গাছের নীচে ছড়িয়ে পড়েছে বাড়ি বদল করবার সময় চার বছর আগে নিয়ে এসেছিলাম পুরনো বাড়ি থেকে গাছ কী ভালোই যে লাগছে এদের ছড়িয়ে পড়া দেখে ছোট ছোট সাদা ফুল শুনেছি সুইট উডরাফ দিয়ে মে ওয়াইন হয়




১৪ই ই মে, ২০১৮
ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
গত বছর পুটুশ ফুটেছিল এখানে সবাই সামারের পর ফেলে দেয় এই গাছ বরফে শিকড় বেঁচে থাকবে না বলে আমি ঘরে নিয়ে এসেছিলাম কেমন কালশিটা পড়ামত হয়ে গিয়েছিল শীতে ঘরে সামার আসতে বাইরে দিয়ে দেখি একটা দুটো নতুন পাতা গজাচ্ছে এখন ফুলে বোঝাই গাছ পুটুশের বুনো গন্ধ আমার বড় প্রিয়



১৭ই মে, ২০১৮
ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
'তুমি যে গিয়াছ বকুল বিছানো পথে' আমার বকুলফুল নেই, আমার সে গান নেই ক্র্যাব আপেলের পাপড়ি বাড়ির আঙিনায় বিছিয়ে আছে বরফের দেশে যা আছে ভাবছি তাতেই বুঝি আমার মুঠো উপচে উঠছে




১৯শে মে, ২০১৮
ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
'ভাবিনি সম্ভব হবে কোনদিন' বাগানের ছোট পন্ডটায় শীতকালের ঝরা পাতা, পাইন নিডল বরফ গলে সব ভেসে উঠেছে পন্ডটার পাশেই বিশাল পাইন গাছটা
আলসি ভেংগে ছাঁকনি দিয়ে সব পরিষ্কার করলাম জলে বুড়বুড়ি কাটবার জন্য সোলার পাওয়ারে চলে এমন একটা ছোট ফোয়ারা দিলাম পার্সেলে আসা কচুরিপানাটা ছাড়লাম কচুরিপানার ফুল আমার বড় প্রিয় । প্রতি বছরই এই উইস্কনসিনে কচুরিপানা লাগাই আমি। ‘ওয়াটার হায়াসিন্থ’। ছাড়লাম শীতকালের গৃহবন্দী শাপলাকেও এখন শুধু ওদের বড় হয়ে ফুল দেওয়ার অপেক্ষা অন্য বছরের মত ফুল ফুটবে তো?

      

২০শে মে, ২০১৮
ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
বিকেলবেলা মনে হ'ল একটু পাড়া বেড়াতে যাই নিজের দরজার পাশে লবেলিয়া ফুলকে হাই বলে তাকালাম রেড ড্রাগন জিওমের দিকে তারপর বাইরের পৃথিবী ঘাস জুড়ে ওয়াইল্ড ভায়োলেট ফুটে আছে এই  ঘাসফুল  উইসকনসিন  এর  স্টেট  ফ্লাওয়ার  অনেকে  উইড  বলে  আমি  তো  ওদের  যত্নে  রাখি  ওয়াইল্ড ভায়োলেট-এর পাশে পাশে ড্যান্ডিলাইনের সাদা তারা ফুঁ দিলেই উড়ে যাবে চারপাশে লাইলাক ফুটে আছে নাক ডুবিয়ে গন্ধ শুঁকলাম পৃথিবীর সেরা সৌগন্ধ লাইলাক ফুলের ঝোপ দেখলে আমার আলুথালু খোপার কথা মনে হয় কিন্তু কাছ থেকে ফুল? পরিপাটি মিষ্টি মেয়ে একেবারে দেখি চারদিক আলো করে গোলাপি রঙের ফ্লাওয়ারিং প্লাম ফুটে আছে আমার আর বাড়ি ফিরে আসতে ইচ্ছে করল না


২১শে মে, ২০১৮
ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
আজ পানপাতা-টাকে রিপট করলাম স্বাস্থ্য বেশী ভালো ছিল না নিম ওয়েল ও স্প্রে করেছি এখন কি আর এই পান খাওয়া যাবে?
আমি জানতাম না কিভাবে পদ্মফুলের বীজ থেকে গাছ করতে হয় গত বছর চেষ্টা করেছিলাম হয় নি টবসহ বীজ পুরো শীতকাল গ্যারেজে পড়ে ছিল গ্যারেজে হীট নেই বাইরে বরফ ঝড়ছে এ বছর সেই বীজ ঠিকমত শিরীষ কাগজে ঘষে জলে ডুবিয়ে রেখেছি মাত্র তিনদিন হল সবুজ আভাস দেখতে পাচ্ছি পড়েছি পদ্মফুলের বীজ নাকি তিনশ বছর পর্যন্ত টিকে থেকে গাছ দিতে পারে সেজন্যই ওর খোলসটা ওমন পাথরের মত শক্ত হয় সত্যি? শক্ত পাথর ফেটে নরম সবুজের এই বের হয়ে আসা এক পরম বিস্ময়
গাছের জগতে আর এক বিস্ময় হচ্ছে জাফরান সেও করেছি এবার টবের ভিতর এই ক্রোকাস ফুলগুলোর স্টিগমাগুলো হচ্ছে জাফরান শুধু কি জাফরান করেই শান্তি? তা দিয়ে বিরিয়ানিও রেঁধে ফেললাম জীবনের রস শেষ পর্যন্ত নেব




২২ শে মে, ২০১৮
ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
সকালবেলা অবাক হয়ে দেখি ম্যান্ডেভিলা লতায় কলি এসেছে পাঁচ বছর পর আরও কিছু সুগন্ধী সাদা পিওনি ফুটেছে এই পিওনিগুলো এই বছরই প্রথম ফুটল আমার হাতে লাগানো গাছ পিওনি নড়াচড়া পছন্দ করে না মাটি খুবলে নিয়ে এসেছিলাম গ্রামের বাড়ি থেকে সাদা ম্যাগ্নোলিয়ার মত গন্ধ ওদের আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে আসে কিন্তু বাড়ির কেউ গন্ধ শুঁকতে বাগানে যাবে না অগত্যা ফুলদানিতে রেখে ধরে বেঁধে ওদের গন্ধ শোঁকাই আমি তো বলি ফুল বাগানের ফসল হচ্ছে পিওনি ঘরে তুলে এনে সম্রাট হওয়া এই তো কটা মাস তারপরই তো আবার সেই বরফ গন্ধরাজ গাছ দুটো কলিতে ভরে গেছে আর ফুটেছে রগুসা রোজ থিরিস বাগনে কাঁটা নেই এই গোলাপে অসম্ভব সুন্দর গন্ধ উইস্কনসিনের শীতকালে বেঁচে থাকে এ গোলাপ এই গোলাপও গ্রামের বাড়ি ছেড়ে চলে আসবার সময় নিয়ে এসেছিলাম প্রাণ ফেলে কি আসা যায়?



২৩ শে মে, ২০১৮
ম্যাডিসন, উইস্কনসিন

বছর দু' তিন আগে জুঁই ফুলের গাছ কিনেছিলাম এখানে নানা ধরণের জুঁই পাওয়া যায় কিন্তু সেই টিয়াজ, লিসাদের গেটের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়া ছেলেবেলার জুঁই কোথাও নেই অনেক খুঁজে সেই  দেশী জুঁই যোগাড় করেছি এ জুঁই তো শুধু ফুল নয়  এর সাথে জড়িয়ে আছে জুঁই ফুল ছাওয়া গেটের নীচে দাঁড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করা; বয়:সন্ধির আনন্দ, বেদনা ; ঘর থেকে ভেসে আসা রবীন্দ্র সংগীত আর  পহেলা  বৈশাখের লুচি, তরকারির গন্ধ কিন্তু এতদিন হয়ে গেল ফুল নেই আজ দেখি পাতার ফাঁকে ওরা হাসছে কী সুন্দর গন্ধ আমার চেনা গন্ধ এদেশে স্টার জেসমিনের গন্ধ আমি নিয়েছি অচেনা সুরে মন আমার ভরে নি ভালোবাসারও একটা সব পেয়ে ফেলেছির মত গন্ধ আছে


২৪ শে মে, ২০১৮
ম্যাডিসন, উইস্কনসিন

সকালে ঘুম ভেংগে দেখি গন্ধরাজ ফুটেছে রাতে বৃষ্টি হয়েছিল স্বপ্নের ভিতর কিন্তু না সব স্বপ্ন নয় বৃষ্টি সত্যি গন্ধরাজও সত্যি বরফ ঢাকা এই উইস্কনসিনে গন্ধরাজের ফুটে ওঠা আশ্চর্য বই কি! কত কষ্ট করে শীতকালের নয়টা মাস নকল আলো দিয়ে ঘরে বাঁচিয়ে রেখেছি গন্ধরাজের গায়ে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির জল আমি এ গন্ধরাজ তুলে এনে কি কাছাকাছি বুকের কাছে রাখব? নাকি গাছেই থাকুক? 



২৫ শে মে, ২০১৮
ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
আজ খুব গরম পড়েছে এখানে ৯০ ডিগ্রী ফারেনহাইট মানে ৩২ ডিগ্রী মত সেলসিয়াস হয়ত বছরে দুটো দিন এমন হয় এখানে
শীতের দেশের মানুষ সব ঘাবড়ে গেছে রেডিওতে বলছে ঘরে থাকতে জল বেশী খেতে এইসব আমি বীর তার মাঝে বাইরে গিয়ে দেখি আর একটা গন্ধরাজ ফুটেছে বাটারফ্লাই বুশে ফুল আর ঘরের ভিতর জলে পদ্মবীজ বড় হচ্ছে আর কত বড় হলে মাটিতে দেব?



৩০শে মে, ২০১৮
ম্যাডিসন, উইস্কনসিন

আজ সকালে মিষ্টি রোদ ছিল এখন কড়া রোদ উঠেছে হাত নিশপিশ করছিল এখন আর গাছ লাগানোর সময় নেই তাই যত্ন করে ওদের জল দিলাম ব্রকলি, পুঁই, কুমড়ো, জুকিনি, শসা, ঢেঁড়স...কী লাগাই নি আমি! এমন কি টবের ভিতর লাগিয়ে ফেলেছি বেগুনি ফুলের জাকারান্ডা, লাল কৃষ্ণচূড়া, রক্তকরবী, ডালিম ফুল, স্বর্ণচাঁপা, রংগন, কামিনী, হাস্নাহেনা, জুঁই, বেলী, গন্ধরাজ, জবা, ঝুমকোলতা... আমার উইস্কনসিনের প্রতিবেশী কোনদিন দেখেনি এইসব গাছ মাথা নাড়িয়ে তারা বলে "exotic" আমি বলতে পারি না আমার আসলে দেশের কথা মনে হচ্ছে
গাছের পাতায় হাত বুলালে গাছ মানুষের মতই ভালোবাসা বোঝে গাছে জল দিয়ে গাছ বাঁচিয়ে রাখতে হয় মানুষের সম্পর্কও তেমনি এক কোণে ফেলে রাখলে তাও মরেই যায়
২রা জুন, ২০১৮
ম্যাডিসন, উইস্কনসিন

"নন্দিনী (জালের দরজায় ঘা দিয়ে) শুনতে পাচ্ছ?
নেপথ্যে নন্দা, শুনতে পাচ্ছি কিন্তু বারে বারে ডেকো না, আমার সময় নেই, একটুও না
নন্দিনী আজ খুশিতে আমার মন ভরে আছে সেই খুশি নিয়ে তোমার ঘরের মধ্যে যেতে চাই
নেপথ্যে না, ঘরের মধ্যে না, যা বলতে হয় বাইরে থেকে বলো
নন্দিনী কুঁদফুলের মালা গেঁথে পদ্মপাতায় ঢেকে এনেছি
নেপথ্যে নিজে পরো
নন্দিনী আমাকে মানায় না, আমার মালা রক্তকরবীর"
আজ এখানে বৃষ্টি হচ্ছে
খুব মনে হচ্ছে রক্তকরবীর কথা বৃষ্টি হলে আমার খুব দেশে চলে যেতে ইচ্ছে করে যে জীবন আমি ফেলে এসেছি, সে যেন আরেক জন্মের আমার স্বপ্নের ভিতর সে ঘোরাফেরা করে আমি খুব দেশের গাছ কিনি যেন এই গাছগুলোকে বুকের কাছে আঁকড়ে ধরতে পারলে দেশ আমার হৃতপিন্ডের কাছে এসে দাঁড়াবে আজ একটা রক্তকরবীর গাছ কিনেছি রঞ্জন, নন্দিনী আমার চোখ থেকে দু ফোঁটা জল ঝরে পড়েছে



২৩ শে জুন, ২০১৮
ম্যাডিসন, উইস্কনসিন

ইভান তুর্গেনেভের “অন দ্য ইভ” উপন্যাসের এই জায়গাটা আমি বারবার পড়ি।
‘Have you noticed,’ began Bersenyev, eking out his words with gesticulations, ‘what a strange feeling nature produces in us? Everything in nature is so complete, so defined, I mean to say, so content with itself, and we understand that and admire it, and at the same time, in me at least, it always excites a kind of restlessness, a kind of uneasiness, even melancholy. What is the meaning of it? Is it that in the face of nature we are more vividly conscious of all our incompleteness, our indefiniteness, or have we little of that content with which nature is satisfied, but something else — I mean to say, what we need, nature has not?’
‘H’m,’ replied Shubin, ‘I’ll tell you, Andrei Petrovitch, what all that comes from. You describe the sensations of a solitary man, who is not living but only looking on in ecstasy. Why look on? Live, yourself, and you will be all right. However much you knock at nature’s door, she will never answer you in comprehensible words, because she is dumb. She will utter a musical sound, or a moan, like a harp string, but don’t expect a song from her. A living heart, now — that will give you your answer — especially a woman’s heart. So, my dear fellow, I advise you to get yourself some one to share your heart, and all your distressing sensations will vanish at once. “That’s what we need,” as you say. This agitation, and melancholy, all that, you know, is simply a hunger of a kind."

সত্যিই কি তাই? প্রকৃতি সম্পূর্ণ করতে পারে না আমাদের? একা একা পথ চলা যায় না? সংগী চাই ই চাই? এ সব প্রশ্নের উত্তর হয় না। প্রকৃতির মাঝে আমার তো এক পরম প্রশান্তি নেমে আসে মনে। কথা বলতে পারি গাছদের সাথে। ওরাও যেন কথা বোঝে। আঁকশি দিয়ে আমায় জড়িয়ে ধরে। নি:সংগতা নয়, পরিপূর্ণতায় ভরে ওঠে মন। পথের পাশের শ্যাওলা সোঁদা গন্ধ হাত বাড়িয়ে ডাকে। একটা লাঠিতে ভর করে বনের পথে হেঁটে যাই। শক্তিমান একা।

২৪ শে জুন, ২০১৮
ম্যাডিসন, উইস্কনসিন

যে প্রকৃতির মাঝে আমি হেঁটে এসেছি, সে আমাকে নিঝুম দুপুরে ঘুঘুর গান শুনিয়েছে; সন্ধ্যায় ডুবে যাওয়া সূর্যের আলোয়, বুকের ভিতরটায় সামনে এক সুখী দিন আছে বলে আশা জাগিয়েছে; পরের দিন ভোরবেলা সে প্রতিশ্রুতি রেখেছে। প্রকৃতি আমার শরীরের চামড়ার মত। তাকে ছাড়া আমার অস্ত্বিত্ব নেই। কিন্তু আমার অস্ত্বিত্বই কি শেষ প্রশ্ন? আমার অস্ত্বিত্বই কি শেষ উত্তর? আমার হাত ধরবার জন্য দাঁড়িয়ে আছে ওরা কারা? যুদ্ধে ভেঙে গেছে ঘর ওদের। রক্তে ভিজে আছে শরীর। পালিয়ে যেতে হচ্ছে ওদের নিজের ঘর ছেড়ে। শুধুমাত্র বেঁচে থাকাটুকু আজ স্বপ্ন ওদের। আমি যদি ওদের হাত ছুঁয়ে নাও ধরতে পারি, বলতে তো পারি ওদের কথা? সিরিয়ার কথা? মেক্সিকোর কথা? রোহিঙ্গাদের কথা? ইজরাইল, প্যালেস্টাইনের কথা?
আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া,
          বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া



৫ই জুলাই, ২০১৮
ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
সমুদ্রের তীরে নিথর হয়ে পড়ে আছে তিন বছরের আইলান কুর্দির শরীর।  শ্যাওলার  মতো  সমুদ্রের  ঢেউয়ে  ভেসে এসেছে সিরিয়ার এক  শিশুর শরীর। ভূমধ্য সাগরের পাড়ে ২০১৫ সালের ২ রা সেপ্টেম্বর।  ‘The Day Humanity Washed Ashore’*.
চোখের উপর ছবিটা এখনো এত স্পষ্ট! সুমদ্রের পাড়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে একটা ছোট্ট শরীরথমকে গেছে বিশ্ব সেই ছবি দেখে৩ বছরের ছোট্ট আইলান কুর্দি। নীল প্যান্ট, লাল টি-শার্ট পরনে। আঁচড় লাগেনি জামা, প্যান্টেযত্নভরে পরানো জুতোজোড়াও অক্ষত ছোট দুটো পায়ে । শুধু শরীরটা নিঃষ্প্রাণ। এ ছবি দেখলে বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে বাচ্চাটাকে। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল ঝরে পড়ে
ইউরোপের দেশগুলোর উদ্বাস্তুদের প্রতি অবহেলার এক ভয়াবহ নিদর্শন হিসাবে বারবার উঠে আসে এই ছবি।
আইলানদের বাড়ি ছিল কোবানি শহরেকুর্দি অধ্যুষিত এই শহর ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গিরা কোবানি দখল করে নেওয়ার ফলে আইএস-এর হাত থেকে বাঁচবার জন্য  ইউরোপের কোনো দেশে যেতে চেয়েছিল আইলানের পরিবার। নৌকায় চেপে বসেছিল। বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে আইলানের বাবা আবদুল্লা কুর্দি বলেছিলেন, চোরকারবারিরা তাদেরকে গ্রীস পার করানোর জন্য নৌকায় তুলেছিল। নৌকাটা সোজা করে রাখবার প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু একে একে চোখের সামনে হাত পিছলে তলিয়ে যায় স্ত্রী রেহান ও দুই পুত্র। পাঁচ বছরের গালিব, বছর তিনেকের আইলান। তুরস্কের সাগর তীরের কাছাকাছি এসে নৌকা ডুবে যায়। তুরস্কের বোদরাম সাগরবেলায় ভেসে আসে আইলানের শরীর ।

কিন্তু লাল টি-শার্ট আর শর্টস পড়া এই শিশু কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। হাজার হাজার সিরিয়ান রিফিউজির একজন আইলানসে তাদেরই একজন যারা বর্ডার অতিক্রম করে একটু ভালো জীবনের জন্য অন্য কোন দেশে পালানোর চেষ্টা করছে ।
সিরিয়া এশিয়ার মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশসরকারী নাম আরব প্রজাতন্ত্রী সিরিয়া। মরুভূমি, উঁচু পর্বত আর উর্বর সমতলভূমির দেশ সিরিয়া। অনেক জাতি  আর ধর্মীয় গোষ্ঠী আছে সিরিয়াতেআছে গ্রীক, সিরিয়ান আরব, আর্মেনিয়ান, মানডিয়ান্স, কুর্দি, কার্কাসিয়ান, আসিরিয়ার মানুষ। ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে আছে সুন্নি, শিয়া, খ্রিস্টান, আলাউই, ইসমাঈল, মান্দিয়া, ডুরজ, সালাফি, ইয়াসীদ ও ইহুদীরা। সুন্নিরা সিরিয়ায় বৃহত্তম ধর্মীয় গোষ্ঠী।
গ্লোবাল পিস ইনডেক্স ২০১৬ মোতাবেক বিশ্বের সবচেয়ে অশান্ত দেশ হচ্ছে সিরিয়া। বিগত কয়েক বছর ধরে আইএস জঙ্গিরা সিরিয়ায় তাণ্ডবকান্ড চালাচ্ছে । আইএস-দের হাতে হাজার হাজার সাধারণ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে সংকটজনক দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সিরিয়ার যুদ্ধ চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চেয়েও বেশিদিন ধরে । যুদ্ধে নিহত হয়েছে ৪৬৫,000 এর বেশি লোক, আহত হয়েছে এক মিলিয়নেরও বেশি আর বাস্তুচ্যুত হয়েছে ১২ মিলিয়নের বেশি । উদ্বাস্তু হয়ে অন্য দেশে পালিয়ে গেছে ৫.৫ মিলিয়ন
মানুষ ।

সংসদীয় প্রজাতন্ত্রের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল সিরিয়া কিন্তু বাস্তবে বাথ পার্টি আর রাষ্ট্রপতির হাতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা । সংবিধানমতে একটি সংসদীয় প্রজাতন্ত্র হলেও ১৯৬৩ সাল থেকে সিরিয়াতে চলছে জরুরি অবস্থা। বর্তমানে জনগণের সরকার পরিবর্তনের কোন ক্ষমতাও নেই । ফলে কার্যত দেশটি একটি একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সিরিয়ার সরকার ইজরায়েলের সাথে ক্রমাগত যুদ্ধকে জরুরি অবস্থার মূল কারণ হিসাবে চিহ্নিত করে ।

পাঁচ বার গনভোটে জিতবার মাধ্যমে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হাফিয আল-আসাদ নিজের কর্তৃত্ব বজায় রেখেছিলেন২০০০ সালের এক গনভোটে তার ছেলে ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি বাশার আল-আসাদ সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি পদে বহাল হন। রাষ্ট্রপতি ও তার মূল সহযোগীরা সিরিয়ার রাজনীতি ও অর্থনীতির মূল সিদ্ধান্তগুলি নিয়ে থাকেন। এক কথায় সামরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরাই আসলে এই সিদ্ধান্তগুলো নেয়। 
আল-জিজিরা খবরের বিশ্লেষণ থেকে জানতে পাই অর্থনৈতিক দুর্দশা ও স্বাধীনতার অভাবের জন্য জনসাধারণের মধ্যে সিরিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে আক্রোশ জমে উঠেছিল । সরকারের বিরুদ্ধে যাওয়ার জন্য বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছিল । তার ফলেও জনগণের মধ্যে বিদ্রোহ দেখা যায়   
২০১১ সালে আরব স্প্রীং নামে পরিচিত বিপ্লব তিউনিসিয়া ও মিশরের প্রেসিডেন্ট-এর পদত্যাগ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল। ফলে গণতন্ত্রের পক্ষের কর্মীদের মধ্যে আশা জেগে উঠেছিল ।
কিন্তু প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের নেতৃত্বে শত শত বিক্ষোভকারীকে সিরিয়ার সরকার হত্যা করে, বন্দী করে তাদের।
২০১১ সালের জুলাই মাসে সামরিক বাহিনীর দলত্যাগীরা ফ্রি সিরিয়ান আর্মি তৈরী করবে বলে ঘোষণা দেয়। এই ফ্রি সিরিয়ান আর্মির লক্ষ্যই হচ্ছে সরকারকে উতখাত করাশুরু হয়ে গেল গৃহযুদ্ধ।
বিদেশী হস্তক্ষেপ ও সমর্থন সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বড় ভূমিকা রেখে আসছে। আসলে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ প্রক্সি যুদ্ধের এক আদর্শ উদাহরণ
২০১৫ সালে রাশিয়া এই সংঘর্ষে নাক গলায়তখন থেকেই রাশিয়া আসাদ সরকারের বন্ধু এবং প্রধান সহযোগী।
শিয়াপ্রধান ইরান ও ইরাক সরকার আসাদকে সমর্থন করে আসছে। লেবানন ভিত্তিক হিজবুল্লাহ বাহিনীও আসাদকেই সমর্থন করে। অন্যদিকে তুরস্ক, কাতার ও সৌদি আরব সহ অন্যান্য সুন্নি-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলির সমর্থন আসাদ বিরোধী বিদ্রোহীদের প্রতি
২০১৬ সাল থেকে সীমান্তের কাছে ইরাকের ইসলামী রাষ্ট্র এবং লেভান্ট(Islamic State of Iraq and the Levant - ISIL, ISIS নামেও পরিচিত)-এর বিরুদ্ধে তুরস্কের সৈন্যরা বেশ কয়েকটি অপারেশন চালায় কুর্দি গোষ্ঠীগুলির সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধেও তুরস্কের সৈন্যরা অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কুর্দি বাহিনীকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০১৪ সাল থেকে আসাদ বিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে অস্ত্র সরবরাহ করে আসছে। চালনা করে আসছে আন্তর্জাতিক আইএসআইএল বিরোধী জোট। আইএসআইএল-এর ঘাঁটি লক্ষ্য করে এই জোট বোমা বিস্ফোরণ করে আসছে।
ইজরাইল সিরিয়ার ভিতরে হিজবুল্লাহ এবং সরকারী পক্ষের যোদ্ধা ও কার্যস্থল লক্ষ্য করে এয়ার রেইড চালিয়েছিল ।
সিরিয়ার বিমান বাহিনী ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথমবারের মত ইজরাইলের যুদ্ধবিমান ধ্বংস করে নীচে নামায় ।
এক কথায় যুদ্ধে প্রধান দুই দল হচ্ছে সিরিয়ার সরকার পক্ষে প্রেসিডেন্ট আসাদের দল ও তার বিপরীতে বিদ্রোহী বিপ্লবীদের দল।
সিরিয়ার সরকারের পক্ষ সমর্থন করছে রাশিয়া, ইরান, হিজবুল্লাহ, শিয়া মুসলিমপ্রধান শক্তি(ইরান, ইরাক, আফগানিস্তান আর ইয়েমেন দ্বারা নিযুক্ত)।
বিদ্রোহী বিপ্লবীদের দলকে সমর্থন করছে তুরস্ক, কাতার, সৌদি আরব সহ অন্যান্য সুন্নি-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জর্ডান
ISIS-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে তুরস্ক আর কুর্দিরা কুর্দিদের অস্ত্র সরবরাহ করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্যি যে তুরস্ক আর কুর্দিরা পরস্পরের চরম শত্রু এবং লড়াই করছে একে অপরের বিপক্ষে। কুর্দিদের সংগ্রাম কুর্দিস্তানের জন্য আর তুরস্ক তার ঘোর বিরোধী।
প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের নেতৃত্বে সিরিয়ার সরকার বিপ্লবীদের ঘাঁটিতে রাসায়নিক বোমা ফেলে। মারা যায় অসংখ্য সাধারণ মানুষআহত হয় অসংখ্য সাধারণ মানুষ। কত নৃশংস হলে নিজ দেশের মানুষদের উপর কেউ রাসায়নিক বোমা ফেলতে পারে!
২০১৩ সাল থেকে সিরিয়ার হাজার হাজার মানুষের উপর রাসায়নিক বোমা আক্রমণ করা হয়ে আসছে। ২০১৩ সালের মার্চ মাসে আলেপ্পোর কাছে প্রথম রাসয়নিক বোমা ফেলা হয় ।   ২০১৮ সালের ৭ই এপ্রিল রাসায়নিক আক্রমণ করা হয় ডুমা শহরে।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে এইসব আক্রমণে ব্যবহার করা হয়েছে সারিন গ্যাস, সাদা ফসফরাস, ক্লোরিন গ্যাস, মাস্টার্ড গ্যাস
সারিন গ্যাস গন্ধহীন, স্বাদহীন এই গ্যাসে আক্রান্ত হলে  স্নায়ুগুলি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। নাক আর চোখ থেকে অঝোর ধারায় জল ঝরতে থাকে they vomit continuously as their bowel and bladder evacuate themselvesএক্সপোজারের মাত্রার উপর নির্ভর করে সারিন গ্যাসে ১০ মিনিটের মধ্যে মৃত্যু ঘটতে পারে.
সাদা ফসফরাস  প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে ব্যবহার করা হয়ে আসছে এটি ধোঁয়া তৈরির জন্য খুব কাজে আসে সংঘর্ষের সময় সৈন্যদের চলাফেরা আড়াল করবার জন্যও খুবই কার্যকরী সাদা ফসফরাসের এক্সপোজারে প্রচন্ড জ্বলুনি হয় কারণ এই গ্যাস চামড়া কামড়ে ধরে   ফলাফলস্বরূপ শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ফসফরাস শুষে নেয় মাত্র ১৫ মিলিগ্রামের সমান ফসফরাস  শরীরে প্রবেশ করলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে মানুষ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ক্লোরিন গ্যাস  রাসায়নিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় ক্লোরিন গ্যাসের এক্সপোজারের ফলে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট  হয় শ্বাসযন্ত্রের ট্র্যাক্ট জ্বলতে থাকে চোখ জ্বলতে থাকে এক্সপোজারের মাত্রার উপর নির্ভর করে চোখ আর শ্বাসযন্ত্রের ট্র্যাক্ট-এর স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে
.
মাস্টার্ড গ্যাস হলদেটে একটা গ্যাস যার গন্ধ সরিষা, রসুন কিংবা হর্সর্যাডিসের মত এই গ্যাস চামড়া আর ফুসফুসে ভয়ংকর ফোসকা ফেলে সাথে সাথে বোঝা যায় না এই গ্যাসের প্রতিক্রিয়া অনেক সময় এক্সপোজারের ২৪ ঘন্টা পরেও দেখা যায় সারা শরীরে ফোসকাগুলো চোখের টিস্যু আর ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয় মাস্টার্ড গ্যাসে আক্রান্ত হলে পরে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে এই গ্যাস ব্যবহার করা হয়েছিল ইরাক-ইরান যুদ্ধে ১৯৭৯-১৯৮৮ সালেও ব্যবহার করা হয়েছিল এই গ্যাস
রাসায়নিক অস্ত্র সভ্যতার অভিশাপ । ভেবে পাই না কিভাবে আমরা এইসব মারণাস্ত্র তৈরী করতে এগিয়ে গেছি । কিভাবে আমরা এইসব অস্ত্র প্রয়োগ করছি। মনে হয় দুঃস্বপ্ন দেখছি না তো? সত্যিই মানুষ এতটা নীচে নেমে গেছে? যখন তাকিয়ে দেখি রাসায়নিক আক্রমণের পরের ছবিগুলো, আশ্চর্য হয়ে যাই। সারি সারি বস্তার মত একজনের গায়ের উপর আর একজন প্রাণহীন মানুষ পড়ে আছে । অথচ সিরিয়ার মানুষের আর্তনাদ আমাদের কান পর্যন্ত পৌঁছাছে না । সিরিয়ার রিফুজিদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য আমরা আমাদের দরজা খুলে দিচ্ছি না। স্বার্থপর আমরা। সমুদ্রের জলে ভেসে আসছে তিন বছরের আইলান কুর্দির শরীর। ভোরবেলা যাকে সুন্দর পোশাক পড়িয়ে দিয়েছিল বাবা, মা নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
তথ্যসূত্রঃ



১৬ই জুলাই, ২০১৮
ম্যাডিসন, উইস্কনসিন

জাতিসংঘের ২০১৩ সালের হিসাব অনুযায়ী রোহিঙ্গারা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত, নিগৃহীত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। এক মিলিয়িনের বেশী  মুসলিম এই রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। অল্প কিছু হিন্দুও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ে আছে।

পশ্চিম মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে কয়েক শতাব্দী ধরে বসবাস করে আসছে রোহিঙ্গারা। মায়ানমারে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় বৌদ্ধরা। বৌদ্ধরা অহিংস হিসাবে জনসমাজে পরিচিত হলেও রাখাইন রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধরা রোহিঙ্গাদের উপর অকথ্য অত্যাচার করে চলেছে। রোহিঙ্গাদের হত্যা করছে তারা, জ্যান্ত পুড়িয়ে মারছে, ধর্ষণ করছে । শুধু তারাই নয়। মায়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীও করে চলেছে বিচারবহির্ভূত হত্যা, শোষণ, অবৈধ গ্রেফতার, ধর্ষণ। একের পর এক পুরুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে আর মেয়েরা হচ্ছে যৌন নির্যাতনের শিকার। ধর্ষণের পর মেয়েদের অর্ধপোড়া মৃতদেহ পড়ে থাকছে মাটিতে । রোহিঙ্গাদের গণহত্যা করা হচ্ছে। এসব অবিশ্বাস্য সব সত্য। মানুষ সুযোগ পেলে কতটা হিংস্র হয়ে উঠতে পারে তার উদাহরণ এই নিরীহ বলে পরিচিত বৌদ্ধরাজাতিসংঘের মতে রোহিঙ্গাদের উপর যে নির্যাতন চলছে তা মানবতা বিরোধী অপরাধ।

দেশের আইনে ১৯৮২ সালে রোহিঙ্গাদের জাতীয়তা অর্জনের সব সম্ভাবনা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ৮ম শতাব্দী পর্যন্ত দেশের ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া গেলেও ওদের দেশটির একটি জনগোষ্ঠী হিসাবে স্বীকার করা হয় না । রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থায় কোন অংশ নেই রোহিঙ্গাদের। সরকারি চাকুরীতে ঢোকবারও কোন অধিকার নেই ।

সবচেয়ে আশ্চর্য যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চির ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন আছে। তিনি সরকারের পক্ষে সাফাই দিয়েই কথা বলে আসছেন। কোথায় একজন নোবেল বিজয়ী হিসাবে রোহিঙ্গাদের পক্ষ নিয়ে রুখে দাঁড়াবেন, নির্যাতিতদের পাশে দাঁড়াবেন, তা না। নিজ আখের গুছাতেই ব্যস্ত অং সান সু চি
শরণার্থী হিসেবে ৯০০,০০০ লক্ষেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। প্রতিবেশী অন্যান্য মুসলিম দেশেও ওরা পালিয়ে গেছে রোহিঙ্গা  বিদ্রোহীদের হামলায় ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট ১২ জন নিরাপত্তা কর্মী নিহত হয় । এর ফলে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মায়ানমার সেনাবাহিনী ক্লিয়ারেন্স অপারেশনশুরু করে। এই “ক্লিয়ারেন্স অপারেশনে” ৩০০০ রোহিঙ্গা নিহত হয়অনেক রোহিঙ্গা আহত, নির্যাতিত, ধর্ষিত হয় । রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়ফলে ৪০০,০০০ এর বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। এরপরও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পালিয়ে আসা অব্যহত রয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের মানুষদের মনে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের বিষয়ে নম্র পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু বহু সাধারণ মানুষদেরই ভাবখানা যেন আমাদেরই খাওয়া থাকার যায়গা নেই, আবার বাইরের মানুষ কেন? আসলে সাধারণভাবে মানুষ যে খুব দয়াশীল তা কিন্তু নয়, মানুষ যে খুব যার প্রয়োজন তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেবে সেরকম নয় । কোনভাবে সে প্রতিদিনের জীবনে হিংস্রতাটুকু ঢেকে রাখে। কিন্তু লেজে পা পড়লেই ফনা মেলে ধরে

https://www.bbc.com/bengali/news-41251493
https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%B9%E0%A6%BF%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A6%BE



১৯শে জুলাই, ২০১৮
ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
“It is a tragedy of both our people. How can I explain in my poor English? I think the Arabs have the same rights as the Jews and I think it is a tragedy of history that a people who are refugees make new refugees. I have nothing against the Arabs ... They are the same as us. I don’t know that we Jews did this tragedy — but it happened.
-Shlomo Green, Jewish refugee from the Nazis, on learning that his home in Israel was taken from a Palestinian family in 1948.”
(http://www.archipelago.org/vol6-3/fisk.htm)
এখনো একটা লোহার চাবি প্যালেস্টিয়ানদের জীবনে বেঁচে থাকবার এক চরম প্রতীক। চাবিটা ফেলে আসা ঘরের সদর দরজার। যে ঘর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল তাদের, যে ঘর ছেড়ে পালিয়ে আসতে হয়েছিল তাদের। একদিন ফিরে যাবে ঘরে এই স্বপ্ন নিয়ে চাবি সাথে নিয়ে ঘোরে প্যালেস্টাইনের মানুষ। ৭৫০,০০০ জন নর নারী, শিশুকে নিজেদের ঘর ছেড়ে দিতে হয়েছিল যেখানে গড়ে উঠেছে আজকের ইসরাইল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ঘর ছিল বংশানুক্রমে পাওয়া পূর্ব-পুরুষের ভিটেমাটি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হলোকস্টের সময় কয়েক মিলিয়ন ইহুদী বাস্তূহারা হয়। এত নির্মমভাবে অত্যাচারিত ইহুদিদের প্রতি বিশ্বের মানবতা বড় সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে। ইউনাইটেড নেশনস্ একটা ইহুদি দেশ প্রতিষ্ঠা করবার কথা ভাবে।
সেই সময়ে প্যালেস্টাইন ছিল ব্রিটিশ কলোনী । প্যালেস্টাইনের অন্তর্গত জেরুসালেম। জেরুসালেম ইহুদি ধর্মের কেন্দ্রস্থল। ইউনাইটেড নেশনস্-এর মনে হল যে ইহুদিদের নতুন দেশ ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করবার সব চেয়ে শ্রেষ্ঠ জায়গা হল প্যালেস্টাইন।
১৯৪৭ সালের নভেম্বরের শেষ দিকে ইউনাইটেড নেশনস্ রেজুলেশন ১৮১ পাশ করাল। যার ফলে প্যালেস্টাইনকে ইহুদি এবং আরব দেশে ভাগ করা হল।
প্যালেস্টাইনের যে আরবরা ওখানে তখন বাস করছিল তারা ওই চুক্তি মেনে নিতে অস্বীকার করে। ইউনাইটেড স্টেটস জানাল যে প্যালেস্টাইনের মত ছাড়া কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না।
কিন্তু রেজুলেশন পাশ করবার সাথে সাথে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল । ইউ এন রেজুলেশন ১৮১ এর আগে যে জায়গাগুলো প্যালেস্টাইনের অংশ ছিল আর এখন যা ইসরাইলের অংশ, তার দিকে তাক করে যুদ্ধ শুরু করে দিল আরব সৈন্যরা।
যুদ্ধ আরো ভয়াবহ আকার নিল যখন এক বছর পর ইসরাইল স্বাধীনতা ঘোষণা করল ।
তখন থেকেই যুদ্ধ বিরামহীনভাবে চলছে। কোন জমি কার হবে, কোন মাটি কার এই নিয়েই যুদ্ধ চলছে প্যালেস্টাইন আর ইসরাইলের মধ্যে বছরের পর বছর ধরে।
আমেরিকা ইসরাইলকে প্রতিদিন ১০.৫ মিলিয়ন ডলার মিলিটারি এইড দেয় । প্যালেস্টাইনকে সেখানে দেয় শূন্য ডলার মিলিটারি এইড ।(https://ifamericaknew.org/stat/usaid.html) ইসরাইল প্যালেস্টাইনের থেকে ধনী, অস্ত্র বেশী আছে, ক্ষমতাও তার বেশী। প্যালেস্টাইনের লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ রিফিউজি ক্যাম্পে আশ্রয় নিচ্ছে এই সংঘর্ষের ফলে।
ইসরাইলের পূর্বদিকে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক। ২.৬ মিলিয়ন ফিলিস্তিনিদের বসবাস সেখানে। কিন্তু ১৯৬৭ সালে ইসরাইল তা দখল করে। তারপর থেকে ইহুদিরা একে একে এসে বসবাস শুরু করে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে। ফিলিস্তিনিরা এবং বিশ্বের আন্তর্জাতিক কন্ঠ মনে করে অন্যায়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে এই ওয়েস্ট ব্যাঙ্ককে ইহুদিরা। ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ফিলিস্তিনিদের।
জেরুসালেম ইসরাইল আর ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের বর্ডারে। ইহুদি এবং মুসলমান দুই ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছেই জেরুসালেম পবিত্র ধর্মস্থান । দুই দলই চায় জেরুসালেমকে তাদের রাজধানী বানাতে। জেরুসালেম নিয়ে ইহুদি আর মুসলমানদের বিরোধ থামবার নয়।
গাজা স্ট্রিপ ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত আর এক বিতর্কিত ভূখন্ড। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত মিশরের অধিকারে ছিল গাজা স্ট্রিপ। তারপর ছয় দিনের যুদ্ধে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের সাথে ইসরাইল দখল করে নেয় গাজা স্ট্রিপ। ২০০৫ সাল পর্যন্ত ইসরাইলের মিলিটারি ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের মতই গাজা অধিকার করেছিল । ইহুদিরা সেখানে বসতি স্থাপনও করে যাচ্ছিল। ২০০৫ সালে তখনকার ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী ইসরাইলের সৈন্য আর বসবাস স্থাপনকারীদের সরিয়ে নেয় গাজা থেকে।
আজ প্যালেস্টাইনের ইসলামী গ্রুপ হামাস-এর তত্ত্বাবধানে গাজা। ১৯৮৭ সালে ইসরাইলের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে এই প্রতিবাদী এবং সন্ত্রাসী  গ্রুপ হামাস। হামাস গ্রুপ গাজা দখল করবার পর পরই ইসরাইল বাণিজ্যিক জিনিষপত্রর গাজাতে প্রবেশ নিষেধ করে ব্লকেড ঘোষণা করে। তাদের অজুহাত হামাস গ্রুপ নাকি ওইসব ব্যবহার করে ইসরাইলের বিরুদ্ধে অস্ত্র বানাবে। এই ব্লকেড সময়ের সাথে সাথে অনেকটা নমনীয় হয়ে এলেও বিদ্যুত, খাবার, ওষুধ থেকে ফিলিস্তিনিদের বঞ্ছিত করে চলেছে ইসরাইল।
দীর্ঘদিনের পারসিকিউশনের শিকার ইহুদিরা। তাদের উপর যে অত্যাচার করেছে নাজিরা, যে নিপীড়ন করেছে তার কোন মাপকাঠি হয় না। কিন্তু ইহুদি শরণার্থীদের ঘর দিতে গিয়ে শরণার্থী হয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিনিরা।
কোন পক্ষে হাত মেলাব আমরা? কোন দলে বেদনার পাল্লা ভারি? কে বেশি নির্যাযিত? মানবতার বাণী কোথায় গুমরে মরছে?
ইহুদিদের রক্ত ঝরছে।  ফিলিস্তিনিদের রক্ত ঝরছে। পবিত্র মাটিতে আরব এবং ইহুদিদের এই সংঘাত থামবার নয়।  ‘It has been referred to as the world's "most intractable conflict”’. সমাধান কি? শান্তির পথ কি? অনেক তত্ত্ব, অনেক আলোচনার পক্ষে, বিপক্ষে যুক্তি দিয়ে আসছেন পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষেরা, রাজনীতিবিদরা। বলা হচ্ছে প্যালেস্টাইন, ইসরাইল মিলে একটা দেশ হোক। বলা হচ্ছে প্যালেস্টাইন, ইসরাইল দুটো দেশ হোক।  কিনতু জেরুসালেম কার হবে? 
https://www.vox.com/cards/israel-palestine
http://ifamericaknew.org/stat/usaid.html
http://thehigherlearning.com/2014/07/10/quickest-possible-explanation-of-the-current-israeli-palestinian-conflict/
https://www.independent.co.uk/voices/palestine-keys-return-home-israel-palestinians-a8398341.html
http://www.wbur.org/cognoscenti/2018/01/04/jerusalem-stacie-goddard
https://israelipalestinian.procon.org/view.resource.php?resourceID=006410
https://www.quora.com/How-much-funding-does-Israel-receive-from-the-USA-and-is-it-justified
https://www.google.com/amp/s/www.theatlantic.com/amp/article/567032/
https://roar.media/bangla/main/history/israel-palestine-conflict-origin/
http://www.archipelago.org/vol6-3/fisk.htm




২৩ শে আগস্ট, ২০১৮
ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
আমেরিকায় বাড়িতে 'মেইড' হিসাবে যে কাজ করছে সে কোন দেশের? ও মেক্সিকান অফিসে বাথরুমগুলো যে পরিষ্কার করছে সে কোন দেশের? ও মেক্সিকান ক্ষেতে খামারে যে কাজ করছে সে কোন দেশের? ও মেক্সিকান ফ্যাক্টরিতে যে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করছে সে কোন দেশের? ও মেক্সিকান
ওরা ইংরেজি প্রায় বলতে পারে না বললেই চলে 'মেইড' হিসাবে ওদের ক্যাশে টাকা দিতে হয় এদেশে আসবার পর এভাবেই বেঁচে থাকা তবু মোটামুটি স উপায়ে উপার্জন আর সহজেই এই কাজগুলো পাওয়া যায়
আমেরিকায় কয়েক মিলিয়ন 'আনডোকুমেন্টেড ওয়ার্কার' আছে আর আছে হাজার হাজার চাকরিদাতা যারা অবৈধভাবে এদের কাজে নিযুক্ত করে চাকরিদাতাদের মতে H-2A এগ্রিকালচারাল ভিসা প্রোগ্রাম-এর জটিল নিয়ম কানুন আর অনেক খরচের জন্য তারা 'আনডোকুমেন্টেড ওয়ার্কার' - দের নিযুক্ত করে আর এও ঠিক যে এইসব ভিসা প্রোগ্রাম দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক তৈরী করে তাদের এদেশে আনা হয় এমন সব হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের কাজ করাবার জন্য যা আমেরিকার প্রথম শ্রেণীর নাগরিকরা করতে চায় না H-2A প্রোগ্রাম নিয়মমাফিক আমেরিকাতে ফার্মে কাজ করবার একমাত্র আইনসম্মত পথ হলেও বেশিরভাগ চাকরিদাতা তা ব্যবহার করে না প্রতি বছর ফার্মের কাজে সারা দেশে প্রায় এক মিলিয়নের উপর 'আনডোকুমেন্টেড ওয়ার্কার' নিযুক্ত করা হয় মেক্সিকোর খুব কাছাকাছি হওয়ায় ক্যালিফোর্নিয়াতে চাকরিদাতাদের পক্ষে অন্যান্য স্টেটের চেয়ে অনেক সহজে 'আনডোকুমেন্টেড ওয়ার্কার' খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়
মেক্সিকোতে কাজ করে খুব কম টাকা পাওয়া যায় সারাদিন কাজ করে যে টাকা তা আমেরিকায় এক ঘন্টার উপার্জন অনেক মেক্সিকান-দের মতে আমেরিকার কনস্ট্রাকশন-এর কাজ আর ব্লু কলার কাজ মেক্সিকোর হোয়াইট কলার কাজের থেকেও বেশি পয়সা দেয়
তাই গত ২০ বছর ধরে মেক্সিকানরা আমেরিকাতে আসছে , জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বর্ডার অতিক্রম করছে - বেআইনিভাবে হলেও
ইউ.এস.. আর মেক্সিকোর বর্ডারের দৈর্ঘ্য ১,৯৮৯ মাইল(,২০১ কিলোমিটার) ১২ ইঞ্চি ব্যাস এইসব স্টিল ফেন্স পোস্টের নতুন ফেন্সগুলো কোন গাড়ির ৪০ মাইল পার আওয়ার ধাক্কা সহ্য করেও দাঁড়িয়ে থাকবার মত করে তৈরী
“The border barriers rise out of the Pacific Ocean, climb craggy California peaks, streak across Arizona desert valleys and meander through cattle ranches and fields of sorghum and citrus in South Texas.
Tall steel fencing separates border communities. Camera towers and bright rows of stadium lights aim at smugglers' enclaves in Mexico. Migrants seeking out traditional crossing routes find them blocked, and many give up.
But migrants still get across, by seeking out the one road or one mountain range or one desert trail beyond the reach of the U.S. Border Patrol.”
কিন্তু কোন চোখে দেখে এই 'আনডোকুমেন্টেড ওয়ার্কার'-দের আমেরিকার প্রশাসন?
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাষায়-
    "When Mexico sends its people, they’re not sending their best... They’re sending people that have lots of problems, and they’re bringing those problems with us. They’re bringing drugs. They’re bringing crime. They’re rapists. And some, I assume, are good people"
    Mexico is "ripping off the US more than almost any other nation"
    "Mexico continues to make billions on not only our bad trade deals but also relies heavily on the billions of dollars in remittances sent from illegal immigrants in the United States"
    "I will build a great, great wall on our southern border, and I will make Mexico pay for that wall. Mark my words"
    "Under my administration anyone who illegally crosses the border will be detained until they are removed out of our country and back to the country from which they came."
কি চরম ঘৃণা!
এখানেই শেষ নয় ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে ঘোষণা হ' 'জিরো টলারেন্স পলিসি' ভিসা ছাড়া যারা আমেরিকার দক্ষিণ দিকের বর্ডার পার হবে সেইসব আশ্রয় আর নিরাপত্তা খুঁজতে আসা মানুষদের সহ্য করা হবে না আর আশ্রয় আর নিরাপত্তা খুঁজতে আসা মানুষদের ভিতর যারা বর্ডার কন্ট্রোল এজেন্টদের কাছে নিজেদের সমর্পণ করেছিল , তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডার্হ অপরাধ আনা হ' যদি তাদের বাচ্চা থাকে তবে সেইসব বাচ্চাদের জোরপূর্বক বাবা, মা, আত্মীয় বা সাথের প্রাপ্তবয়স্ক মানুষটি থেকে আলাদা করে ডিটেনশন সেন্টারে পাঠিয়ে দেওয়া হ' আর বাবা মা-দের পাঠানো হ'ল ফেডারেল জেল- উনিশে এপ্রিল থেকে শুরু ক'রে একত্রিশে মে পর্যন্ত প্রায় ১,৯৯৫ জন বাচ্চাকে এইভাবে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে মা বাবা কে হারিয়ে বাচ্চারা কেঁদেছে, মা বাবা কেঁদেছে, নীতির নড়চড় হয় নি
অবশেষে সাধারণ মানুষের প্রবল প্রতিবাদ, রাজনৈতিক চাপ আর বহির্বিশ্বের চাপে ২০১৮ সালের জুন মাসে ট্রাম্প সরকার অনির্দিষ্টকালের জন্য এই নীতি স্থগিত করতে বাধ্য হয় কিছুটা হলেও যেন মানবতার জয় শুনতে পাই




২৫ শে আগস্ট, ২০১৮
ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
সিরিয়ার কথা বললাম, রোহিঙ্গাদের কথা বললাম লিখলাম ইজরাইল-প্যালেস্টাইনের কথা, মেক্সিকোর কথা পৃথিবীর আরো আরো রিফুজিদের কথা আমি বলে শেষ করতে পারব না শেষ করতে পারব না ইমিগ্র্যান্টদের বেদনার কথা লিখে নিজের ব্যক্তিগত বেদনাকে অতিক্রম করবার জন্য প্রকৃতির কাছে ছুটে যাই তারপর ভাবতে চেষ্টা করি বিশ্বের মানুষের কথা নিজেকে অতিক্রম করে অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়াই তো মনুষত্ব হাত পা অবশ হয়ে যায় মুক্তি কোথায়?

মাথার ভিতর গুনগুন করে জন লেননের গান
“Imagine there's no heaven
It's easy if you try
No hell below us
Above us, only sky
Imagine all the people living for today
Imagine there's no countries
It isn't hard to do
Nothing to kill or die for
And no religion, too
Imagine all the people living life in peace
You...

You may say I'm a dreamer
But I'm not the only one
I hope some day you'll join us
And the world will be as one


Imagine no possessions
I wonder if you can
No need for greed or hunger
A brotherhood of man
Imagine all the people sharing all the world”

যদি সত্যিই দেশের কোন সীমানা  না থাকে, কোন ধর্ম না থাকে, কোন সম্পদের গর্ব  না থাকে, লোভ আর ক্ষুধার প্রয়োজন  না থাকে কেমন হবে সে পৃথিবী? মানুষ একে ওপরের কাঁধে হাত রেখে এগিয়ে যাবে? বুকে জড়িয়ে ধরবে? রক্তপাত বন্ধ হ'বে? হত্যা বন্ধ হবে? অসম্ভব সে স্বপ্ন? "Imagine there's no countries. . .Imagine all the people sharing all the world . . ."

ভোর রাতে এ রকম স্বপ্ন দেখে মানুষ সে স্বপ্নের উপর শিউলি ফুল ঝরে পড়ে চারপাশে তখন পাখিরা গান গায় পাখিদের জেগে উঠবার সময় ভোর রাত অদ্ভুত এক বাতাস বয়

মানুষের স্বপ্ন সফল হোক



২৯ শে আগস্ট, ২০১৮
ম্যাডিসন, উইস্কনসিন

২৯ শে আগস্ট। আমার গর্বের দিন, একটু মন খারাপেরও দিন।  অনন্য আজ ইউনিভার্সিটিতে যাবে।  আঠারো বছর বয়স হয়েছে।  আমেরিকার সমাজ ব্যবস্থাতে পূর্ণবয়স্ক ও। নিজের সবকিছু নিজে করবে। ডাক্তাররা ওর প্রাইভেসি রেখে কোন কিছু আর বাবা, মা-কে বলবে না। ইউনিভার্সিটিতে ও কেমন করছে ক্লাসে তা আর জানাবে না।  জানি না এ নিয়ম ভালো কি খারাপ।  এই পঞ্চাশ বছর বয়সেও তো আমার মা আমার সব খোঁজ জানে। ওষুধ খেলাম কিনা। খেয়ে জল খেলাম কিনা। ঘুমাতে গেলাম কিনা সময়মত। তাই কেমন একটা আলুথালু ভাব আমার। এই বুঝি সবকিছু আমার হাতের বাইরে চলে  গেল। 
নিজে নিজে সব করতে পারে, এমনভাবে গড়ে তুলিনি অনন্য-কে। বড় ভয়, বড় চিন্তা  নিজে নিয়ে এখন জলটা খেতে পারবে তো? আর আমিই বা কি করব? পুরোপুরি বেকার।  তাও ঘরে লাবণ্য টা আছে আর বছর দুই-এর জন্য। এখনো ওকে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতে হয়, নিয়ে আসতে হয়। এখনো যখন তখন শুনতে পাই, 'মাম,....' 
অনন্য চলে যাবে বলে আমি অফিস থেকে পাঁচদিন ছুটি নিয়ে বসে আছি। ওকে নিয়ে যাচ্ছি সকালে বা রাতে ওর প্রিয় রেস্টুরেন্ট-এ খাওয়াতে। ও যদিও খেতে চাচ্ছে আমার করা মুশুরির ডাল, ভা্‌ত, ঢেঁড়স ভাজি, চিংড়িমাছের মালাকারী  সবচেয়ে প্রিয় খাবার ওর। সারাদিন বাজার করছি গত একমাস ধরে।  কত কি  লাগতে পারে ডর্ম রুমের জন্য? তোয়ালে, বিছানার চাদর, শ্যাম্পু, সাবান, সোপ ডিস্পেন্সার...
বুকের ভিতরটা রিনরিন করছে। মনে পড়ছে যখন কিন্ডারগার্টেনে পড়তে গিয়েছিলো, আমার মহা ব্যস্ততা দেখে ও বলেছিল ,  মাম, এ্যাকচুয়ালি আই ডোন্ট নীড ইউ এনি মোর।ব্যাকপ্যাক পিঠে বেঁধে, হলুদ বাসে চেপে দিব্যি চলে গিয়েছিল স্কুলে। তখনও কতবার যে দোকানে দোকানে ঘোরা আমার ! স্কুলের সাপ্লাই লিস্ট মিলিয়ে মিলিয়ে 5.8 X 2.5 X 1.5 সাইজের পেন্সিল বক্স, আর্ট স্মক, ক্রেঅন, নাম্বার টু পেন্সিল, উডেন রুলার, টু-পকেট ফোল্ডার, স্পাইডারম্যান ব্যাকপ্যাক...কত কী যে ছোট ছোট জিনিষ... 
এবারের যাওয়াটা আর একটু অন্যরকম যদিও। ও কি আর বাড়িতে আসবে না? কত ঘন ঘন আসবে? উইক-এন্ডে আসবে? বড় ছুটিগুলোয়? কতটুকু দেখতে পাব? নতুন বন্ধু হ'ল কিনা বলবে আমায়? বলবে কেমন লাগছে নতুন ক্লাস? সামলাতে পারবে সবকিছু? আমার কোন সাহায্যই ওর আর লাগবে না? চোখের কোণের জলটুকু মুছি। 
আমি ভাবি আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত বাচ্চারা রেশমগুটির নিশ্চিন্ত জীবনে থাকে। চিন্তা নেই বেশি। রেশমগুটির কথা ভেবেই কলেজ যাওয়ার আগে তাই  অনন্য-এর জন্য আমি একটা  মালবেরি গাছ কিনেছি। গাছটার দিকে তাকিয়ে অনন্য কেমন আছে জানতে পারব। গাছটার পাতা সূর্যের দিকে যখন দু' হাত বাড়িয়ে মেলে ধরবে, জানব অনন্য ভালো আছে। কুসংস্কার আমার অনেক!
মালবেরির পাতা খেয়েই রেশমগুটি বানায় রেশম পোকা। তারপর একদিন গুটি কেটে পাখা মেলে উড়ে যায়।  আমার অনন্য-র পাখা মেলবার সময় হয়েছে। বিরাট, উন্মুক্ত পৃথিবী ওর সামনে।  ইচ্ছে করলে সারা পৃথিবীটাই নিজ হাতের মুঠোয় নিতে পারবে। নিজেকে বারবার বলি - আমি পিছুটান হব না। তবু বুকের ভিতর ব্যাথাটা বেড়ে ই চলে। 
লাবণ্য আর আমি আমাদের মত করে ওর ঘর গুছিয়ে দেই। আজ ও যে আমাদের এটুকু করতে দিচ্ছে, তাতে একেবারে ধন্য হয়ে যাই। নিজেদের হাতের ছোঁয়া ডর্ম রুমের যত বেশি জায়গায় রেখে যেতে পারি।  সবটুকু ভালোবাসা। 
সেই সকালে এসেছি। প্রায়  সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মন না চাইলেও অনন্য-কে একা রেখে এবার যেতে হবে। একে  একে আমাদের জড়িয়ে ধরে অনন্য আশ্চর্য হয়ে দেখি আমার চোখ বেয়ে জল নামছে না। মনে মনে শুধু আমি বিড়বিড় করে বলি , ‘ Just when the caterpillar thought the world was over, it became a butterfly.’
আমার রেশমগুটি।